২০শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

চট্রগ্রামে নেই সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বাড়ছে জনদুর্ভোগ

চট্রগ্রামে নেই সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বাড়ছে জনদুর্ভোগ

চট্রগ্রামে নেই সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
ফাইল ছবি

চট্রগ্রামে ত্রিমুখী সড়ক সংযোগ, রেয়াজউদ্দীন বাজারের ক্রেতা-বিক্রেতার আনাগোনা আর রাস্তার গায়ে লাগোয়া বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদির দোকান পত্র এসব নিয়েই ব্যস্ততার পসরা খুলে বসেছে নগরীর ‘আমতল’ জায়গাটি। আর এই পথ দিয়েই প্রতি সকালে ছুটছেন শত শত মানুষ। স্কুল শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে কর্মব্যস্ত নাগরিক কেহই বাদ পড়েন না এই তালিকা থেকে। চলতি পথে গাড়ির গ্লাসের ফাঁক দিয়ে কিংবা খালি চোখে যে জিনিসটি দৃশ্যমান হয়Ñরাস্তা দখল করে পড়ে থাকা আবর্জনার স্তূপ! সাত সকালে যেখানে নির্মল ঝিরঝিরে বাতাস এসে দোলা দেয়ার কথা, সেখানে আবর্জনার উৎকট গন্ধে নাকে রুমাল চাপা দিতে হয় আমাদের! বলা হয়ে থাকে, সকাল ভালো তো সারাদিনই ভালো। কেননা, একটি নতুন সূর্য মানে একটি নতুন সকাল। আর প্রতিটা সকাল-ই সূচনা বার্তা পাঠায় এক একটি দিনের।[ad id=”28167″]

২০১৩ দেয়া সিএমপি’র একটি তথ্যসূত্র হতে জানা যায়, চট্টগ্রাম মহানগরীতে বর্তমানে ৫০ লাখের মতো নাগরিক বসবাস করছেন। মহানগরীতে বসবাসরত প্রত্যেকেই নাগরিক সুবিধা ভোগ করার বিপরীতে পরিশোধ করে যাচ্ছেন সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক আরোপিত কর। আর সেই কর-এর টাকাতেই নগরীতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু দক্ষ ও মেধাবী মানবসম্পদ ব্যতিরেকে শুধুমাত্র অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে এই বন্দরমাতা চট্টগ্রামের অগ্রগতি সত্যিই অবরুদ্ধ। আমরাই বলে থাকি, শিশুরা অপার সম্ভাবনাময়। বিদ্যালয়ের গ-ীতে আবদ্ধ শিশুটিই আগামী দিনের নেতৃত্ব দিবে। কিন্তু আজকের যে শিশুটি বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্যহীনতা, দূষণ-এসবের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠছে সেটি আমাদের জন্য সুখকর কিছু নয়। উপরন্তু সেটি মেধাশূন্য নেতৃত্ব তুলে আনারই নামান্তর।

বর্তমানে আমরা নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি। আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, বৃদ্ধি পেয়েছে আমাদের জীবনযাত্রার মানও। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ অর্জনের লক্ষ্যে। জনসংখ্যাকে মানবসম্পদে রূপান্তর করা ছাড়া শুধুমাত্র নগরায়ন কিংবা কাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে আমরা খুব বেশিদূর এগোতে পারবো না। আর একটি সুস্থ-স্বাভাবিক পরিবেশই মানবসম্পদ উন্নয়নের সূতিকাগার হিসেবে বিবেচিত।

খুব সূক্ষ্ম দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে নাগরিক জীবনের দৈনন্দিন বর্জ্য সামগ্রীকে যে কটি ভাগে ভাগ করা যায়, তাদের মধ্যে হল-গৃহস্থালী বর্জ্য, পয়ো ব্যবস্থার মাধ্যমে সৃষ্ট বর্জ্য, কলকারখানায় সৃষ্ট বর্জ্য, নির্মাণ সামগ্রী ও বৈদ্যুতিক মেরামতের ফলে সৃষ্ট বর্জ্য সর্বোপরি হাসপাতাল থেকে ব্যবহার্য অবশিষ্টাংশ। গৃহস্থালী বর্জ্যে অন্য সকল প্রকারগুলো থেকে কম রাসায়নিক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ভৌত অবস্থার উপর ভিত্তি করেও এদের রকমফের হয়ে থাকে। বর্জ্য সাদা হোক কিংবা কালো হোক, কঠিন কিংবা তরল যাই হোক না কেন বর্জ্য বর্জ্য-ই। যত্রতত্র বর্জ্যরে এ অনিয়ন্ত্রিত সমারোহ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হল সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার। দিনের বেলায় ডাস্টবিন কিংবা কন্টেইনার থেকে বর্জ্য অপসারণের ফলে সৃষ্ট যানজট এড়াতে বর্তমান মেয়র শুভ উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। শ্রমিকরা রাত ১১টার পর থেকে নির্ধারিত স্থান থেকে ময়লা সংগ্রহ করে ভাগাড়ে ফেলেন, বড় জোর ফায়ার ট্রিটমেন্ট করেন। সিটি করপোরেশন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বলতে আদতে কি এই টুকুনি বুঝেন! এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ও উদ্যোমী শিক্ষক এস এম মুর্শিদ উল আলম মনে করেন-‘বর্জ্য অপসারণ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা দুই মেরুতে অবস্থিত ভিন্ন দুটি বিষয়। অনেকেই হয়ত ভেবে থাকেন ডাস্টবিন কিংবা কন্টেইনার থেকে বর্জ্য অপসারণ করে নিয়ে যাবার অর্থই হল বর্জ্যরে সঠিক ব্যবস্থাপনা। আদতে কিন্তু তেমনটি নয়। মেধাবী এই জিন বিজ্ঞানীর পরামর্শ হল- সামগ্রিক বর্জ্য পদার্থ গুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করে নেয়া। আর সেগুলো হল-পচনশীল, অপচনশীল এবং ই-বর্জ্য (ইলেক্ট্রনিক বর্জ্য)। বর্জ্য ফেলা এবং সংগ্রহের জন্য ভিন্ন রংয়ের ৩টি বিন ব্যবহার করা যেতে পারে। ফলশ্রুতিতে নির্দিষ্ট রংয়ের বিন থেকে বর্জ্য নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে ডাম্পিং করাটা তুলনা মূলক সহজসাধ্য হবে। তবে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে। কেননা ইলেক্ট্রনিক বর্জ্যে বিভিন্ন ভারী পদার্থ এবং কারসিনোজেনিক পদার্থ বিদ্যমান থাকে যার সংস্পর্শ থেকে বর্জ্য অপসারণের জন্য নিয়োজিত কর্মীদের পর্যন্ত ক্যান্সার থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকি হতে পারে। সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষের মনিটরিং ব্যবস্থা নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেন-বর্তমানে নগরপিতা বন্দরনগরীকে ‘গ্রীন সিটি’তে রূপান্তরের যে শুভ উদ্যোগ নিয়েছেন সেটি অবশ্যই প্রশংসনীয়। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে বর্জ্য ফেলানোর জন্য যেসকল ডাস্টবিন কর্তৃপক্ষ দিয়েছেন সেগুলোর অধিকাংশই হচ্ছে বাজার, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি জায়গাগুলোকে ঘিরে। কিন্তু বর্জ্য অপসারণের জন্য স্থাপন করা ডাস্টবিনগুলো হওয়ার কথা ছিল ঘনবসতিপূর্ণ ও আবাসিক এলাকার বাইরে। বর্জ্য বাহী গাড়িগুলোর দিকে তাকালে আরেকটি ব্যাপার লক্ষ্য করা যায় অপসারণের কাজে ব্যবহৃত গাড়িগুলো থেকে গড়িয়ে পড়ছে বর্জ্য পদার্থ যা থেকে অনায়াসেই ছড়াতে পারে রোগ জীবাণু। এ ব্যাপারে তিনি কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতাই আশা করছেন।

বন্দরনগরীতে বসবাসরত অর্ধকোটি মানুষ এবং নগরায়নের সাথে সংশ্লিষ্ট শিল্প প্রতিষ্ঠানই যে শুধু বর্জ্য উৎপাদন করছে তা কিন্তু নয়। এর বাইরেও বাড়তি কিছু বর্জ্য পদার্থ উটকো ঝামেলা হিসেবে যুক্ত হচ্ছে। যেহেতু চট্টগ্রাম নগরী সড়ক, রেল,নৌ ও আকাশ পথের সংযোগ রয়েছে সেহেতু প্রতিদিনই বাস থেকে শুরু করে ট্রেন এমনকি জাহাজের মাধ্যমেও প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে বর্জ্যরে নিত্য নতুন তালিকা। এ সকল পরিবহন শুধুমাত্র যাত্রীদেরই বহন করে নিয়ে আসছে না। আনছে বর্জ্য সামগ্রীও। আর এটি রোধ করার একমাত্র উপায় হল প্রবেশদ্বার (ঊহঃৎধহপব চড়রহঃ) গুলোতে মনিটরিং এর যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ। বর্জ্যরে এমন অব্যবস্থাপনা দেখে অভ্যস্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের ¯œাতকোত্তর শেষ পর্বের ি শক্ষার্থী সিনথিয়া আলম শর্মি। অনেকটা অভিযোগের স্বরেই তিনি বলেন-এ বর্জ্যই যেন আমাদের নিত্যসঙ্গী। রাস্তার পাশে ফুটপাতে অনেকটুকু জায়গা জুড়েই পড়ে থাকে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। আমাদের মত সাধারণ মানুষকে প্রতিদিনই এই নোংরা-দুর্গন্ধময় পরিবেশের মধ্য দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। বর্জ্যরে এমন অনিয়ন্ত্রিত আর অব্যবস্থাপনা দেখে মনে হয় সাধারণ মানুষের কথা ভাবার সত্যিই কেউ নেই!

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তণ শিক্ষার্থী দীপংকর দেওয়ানজীর কথায় উঠে আসে নগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সাম্প্রতিক চালচিত্র। তিনি বলেন, ‘মানছি সিটি কর্পোরেশন কিছু সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কিন্তু সেগুলো মনিটরিং এর ব্যবস্থা কোথায়? কর্তৃপক্ষ মাইকিং করে প্রচারণা চালিয়েছেন ৬টা থেকে ১০টার মধ্যে নির্ধারিত স্থানে ময়লা ফেলানোর জন্য। কাজটি আরো কিছুটা সহজতর হত যদি মাইকিং এর সাথে সাথে প্রত্যেকটি পরিবারে প্রচারপত্র বিলি করা হত।’ তিনি আরো যুক্ত করে বলেন-‘সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ যদি সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলদের দায়িত্ব দিয়ে দেন মনিটরিংয়ের জন্য তাহলে কাজটি আরো কিছুটা বেগ পেত।’

সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেন-বর্তমানে নগরীর অধিকাংশ এলাকাই গ্যাস সংকটে ভুগছে। আমরা যদি পচনশীল বর্জ্যগুলোকে আলাদা করতে পারি এবং বিশেষজ্ঞের পরামর্শক্রমে ঊভভষঁবহঃ ঞৎবধঃসবহঃ চষধহঃ (ঊঞচ). ব্যবহার করতে পারি তাহলে বায়োগ্যাস উৎপাদনের মাধ্যমে সাম্প্রতিক সময়ের গ্যাস সংকট অনেকাংশেই কেটে যাবে। সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে যে শুধু জৈব জ্বালানি উৎপাদন করা যাবে তা কিন্তু নয় কম্পোজ সার উৎপাদন এবং এর বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ ও তৈরী করতে পারব আমরা।

বর্তমানে ডেঙ্গুর মত ভয়াবহ আরেকটি রোগ ছড়িয়ে পড়ছে এবং তা জিকা ভাইরাসের মাধ্যমে সৃষ্ট। ডেঙ্গুর মত এই রোগটিও মশাবাহিত। যত্রতত্র বর্জ্যরে এহেন অব্যবস্থাপনাই দায়ী মশা উৎপাদনের অভয়ারণ্যে করে তুলতে। একটা সময় মশা নিধনের জন্য সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ স্প্রে করার মত উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে সে উদ্যোগটিও চোখে না পড়ার মতোই বলে জানান চমেক হাসপাতালের অনারারী মেডিক্যাল অফিসার মোস্তফা মোর্শেদ আকাশ। বর্জ্য অপসারণের সাথে জড়িত কর্মীদের স্বাস্থ্যসেবা প্রসঙ্গে তিনি বলেন-যেহেতু তারা বর্জ্য সংগ্রহের জন্য সরাসরি বর্জ্যরে সংস্পর্শে যাচ্ছেন সেহেতু তাদের চর্ম ও শ্বাসনালীর সংক্রমণ জনিত বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে। এ ব্যাপারে শ্রমিকদের পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে ধারণা দেয়া এবং প্রতি মাসে স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন তিনি।

সুফি-আউলিয়ার পুণ্যভূমি, মাস্টারদা-প্রীতিলতা-বিনোদবিহারীর মত বীরের প্রসবিনী চট্টগ্রাম চিরযৌবনা প্রাচ্যের রানী, রূপে-সৌন্দর্যে সে চির অনন্যা কর্ণফুলীর পবিত্র বায়ুতেই আমাদের বেড়ে ওঠা। এই মহানগরীতে বসবাসরত সকল নাগরিকই দায়িত্ব এই শহরের বায়ুর বিশুদ্ধ নির্মল রাখার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগটুকু স্বীকার করা। ব্যক্তি পর্যায় থেকে উদ্যোগী হয়ে না উঠলে কর্তৃপক্ষ সদিচ্ছা-আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও এ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্ভবপর নয়। কবি বলে গেছেন-আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে? ধোঁয়া-ধুলো আর বালিতে ঘেরা এ শহরে সূর্য প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়িই উদিত হবে। তবে সে সূর্য দিনের শুভ কোন বার্তা বয়ে আনতে ব্যর্থ হবে যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা সচেতন হব।

নগর পিতার দুঃসাহসিক একটি উদ্যোগের মাধ্যমে আজ আমরা খালি চোখেই আমরা আকাশ দেখতে পাচ্ছি। তিনি এই মহানগরের অভিভাবক। নগরবাসীর সার্বিক নাগরিক সুবিধার নিশ্চয়তা বিধান করাও তাঁর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমরা আশা করব, সঠিক, সুষ্ঠু ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য উদ্যোগী হয়ে নগরবাসীকে নির্মল একটা পরিবেশ উপহার দিবেন তিনি। আমরা আমাদের এই নগরকে শুধু ইট-পাথরের ছাপিয়ে রাখতে চাই না। প্রাচ্যের রাণীকে নগরায়নের বিষাক্ত ছোবলে আক্রান্ত হয়ে যে বলা না হয়Ñদাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর!”
সবুজ মন্ডল
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
Share on facebook
Share on twitter
Share on whatsapp
Share on print

মন্তব্য করুন

সর্বশেষ সংবাদ