[english_date]

“চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা ও নাগরিকসচেতনতা”

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ
বার আউলিয়ার পূন্যভূমি এই চট্টগ্রাম, বাংলাদেশের প্রবেশদ্বার ।। ঐতিহাসিকদের মতে চট্টগ্রাম শহরের বয়সপ্রায় একহাজার দুইশত বছরেরও বেশি। ঐতিহাসিকরা হিসাব করে দেখিয়েছেন খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে আরব আর ইউরোপীয় বণিকরা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর ফেলেছিল। বিশ্বে যে কয়টি চলমান বন্দর আছে, চট্টগ্রাম বন্দর তাদের অন্যতম। বিশ্বের অনেক দেশের বন্দর অকার্যকর হয়েছে কালের পরিক্রমায়।চট্টগ্রাম বন্দর এখনো স্ব-মহিমায় জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।। ইতিহাস-ঐতিহ্যের দিক থেকে চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অন্যান্য জেলা থেকে অনেক বেশি স্বতন্ত্র। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে এ শহরের যে জৌলুস ছিল বর্তমানে তার সিকি ভাগ ও নেই। কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে বসেছে চট্টগ্রামের ইতিহাস ঐতিহ্য । বর্তমানে শহরটি পরিত্যক্ত শহরে পরিনত হতে চলেছে। বসবাসের অনুপযোগী হতে পারে পরবর্তী এক দশকের মধ্যে।

ঐতিহাসিকরা একসময় লিখবেন একদা কর্ণফুলী নদীর তীর ঘেষে চট্টগ্রাম নামীয় অপূর্ব এক শহর ছিল!হয়ত পাঠ্যপুস্তকে চট্টগ্রাম শহরের করুণ পরিণতির ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করে লিখবে একদা কোন এক সময় চট্টগ্রাম নামে এক শহর ছিল! অথচ যাকে চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং ঘুমন্ত পরির সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। সেই ঘুমন্ত পরিটিকে আমরা নাগরিকরা হত্যা করে চলেছি প্রতিনিয়ত। এই শহরে পা ফেলেছিল মরক্কো থেকে আসা পরিব্রাজক ইবনে বতুতা, পর্তুগিজ বণিকদল সহ অসংখ্য ধর্ম প্রচারক । ইবনে বতুতা চট্টগ্রাম সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন যে, চট্টগ্রাম ভাল জিনিষে ভরপুর একটি বেহেস্ত । চট্টগ্রাম শহরের এ করুণ পরিণতির জন্য সবচেয়ে বেশী দায় এই শহরে বসবাসকারী নাগরিকদের,অনেকে এর জন্য সরকার, মেয়র, সিটি করপোরেশনকে দায়ী করে; আসলে কি দায় সরকার, মেয়র, সিটি করপোরেশনের? প্রতি বছরের মতো এবারও হঠাৎ অতিবৃষ্টি মৌসুমী জোয়ারের কারণে শহরের বিস্তীর্ণ এলাকা একেবারে পানির নিচে তলিয়ে গেল। মানুষ পড়ে গেল চরম দুর্ভোগে। আমরা সবাই সরকার ও সিটি করপোরেশনের মেয়র সহ সেবা সংস্থা সমূহকে দায়ী করলাম। কিন্তু এ পরিস্থিতির জন্য প্রকৃত অর্থে যারা দায়ী, এ শহরের বাসিন্দাদের কথা কেউ মুখেও আনল না। হ্যাঁ, এ শহরকে বসবাসের অনুপযোগী করার জন্য যারা প্রকৃত অর্থে দায়ী তারা হচ্ছে সম্মিলিতভাবে এ শহরের বাসিন্দারা। জলাবদ্ধতার জন্য চট্টগ্রাম নগরের সব অধিবাসী দায়ী। আমরা প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সাথে বিরুপ আচরন করছি । প্রকৃতি ও প্রতিশোধ নেবে এবং তা নেওয়া শুরু করেছে। চট্টগ্রাম বন্দর চালু হওয়ার আগে মহেশখালে বিদেশী জাহাজ ভিড়ত যথারীতি পণ্যদ্রব্য খালাসও হত । কোথায় সেই মহেশখাল? মহেশখালকে আমরা নিঃশেষ করে দিয়েছি, যেটুকু অবশিষ্ট আছে তাও আবর্জনার বাগাড়ে পরিণত করেছি। ফলশ্রুতিতে বন্দরনগরী চট্টগ্রামেরবিস্তীর্ণএলাকার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়েছে; অধিকাংশ রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে,সড়কে নৌকা চলাচল হয়ে উঠেছে যেন এক সাধারণ চিত্র। ফলে অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, লেখাপড়াসহ সামগ্রিক জীবনযাপনে দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। নাগরিকরা যতক্ষণ পর্যন্ত এটির ভয়াবহতা সম্পর্কে উপলব্দি করতে না পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত, কোনোসেবা সংস্থা ওয়াসা,পানি উন্নয়ন বোর্ড, সিডিএ,বিদ্যুত বিভাগ,টিএন্ডটি বিভাগ,সিটি কর্পোরেশন, সরকার, বা মেয়রের পক্ষে কোন ভাবেই সম্ভব নয় এ শহরকে রক্ষা করা।

আমরা বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই বুঝতে পারব না একদা কেমন ছিল বাংলাদেশের এই বাণিজ্যিক রাজধানী। চট্টগ্রামের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় যে ,বাংলাদেশের এটি একমাত্র জেলা অথবা শহর, যেখানে নদী, সমুদ্র, পাহাড় আর সমতলভূমি আছে বা ছিল। জলাবদ্ধতা কী, তা এ শহরের মানুষ জানতই না। কারণ শহরের পানি কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়ার জন্য শহরের উত্তর-দক্ষিণ আর পূর্ব-পশ্চিমে একাধিক খাল ন্যূনতম ৩০ থেকে ৪০ ফুট প্রশস্ত ছিল, যার অন্যতম চাক্তাই খাল। এক সময় সেই খালে নৌকা চলত, ব্যবসায়ীরা এই চাক্তাই খাল দিয়ে বহদ্দারহাট ও চকবাজারে মালামাল আনা নেওয়া করতো। স্পিডবোটে গ্রাম থেকে শহরে যাওয়া–আসা করতেন বিত্তবান ব্যক্তিরা। কালক্রমে চট্টগ্রামের দখলবাজরা সেইখাল বহু আগেই দখল করে ফেলেছে।চট্টগ্রামে পঞ্চাশ-ষাটের দশকে যে পাহাড় গুলো ছিল, সেগুলো এখন আর নেই। কারণ প্রভাবশালীদের জন্য হাউজিং আর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বানাতে হলে এসব পাহাড় কাটতেই হবে। সেই কাটা পাহাড়ের মাটি একটু বৃষ্টি হলেই পানির সঙ্গে মিশে নালা-নর্দমায় এসে জমা হয়, পানি নিষ্কাশন বন্ধ হয়। একসময় পলিথিন ব্যাগ বন্ধ করতে সরকার কিছুটা হলেও সফল হয়েছিল; কিন্তু পরবর্তী সময়ে সরকার তার সেই সফলতা ধরে রাখতে পারেনি। কাঁচাবাজারে গেলে আড়াইশ গ্রাম তরকারি নিলে দোকানদার না চাইতেই তা একটি পলিথিন ব্যাগে ভরে দেয়। বাংলাদেশে ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো বড় বড় শহরে এসব পলিথিন ব্যাগের শেষ গন্তব্য নালা-নর্দমা। গৃহস্থালির বর্জ্য, বাজারের বর্জ্য, কমিউনিটি সেন্টারের বর্জ্য খালগুলোতে পড়ছে। চট্টগ্রামের মাননীয় মেয়র বিনামুল্যে করপোরেশনের লোকদের দিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দিনের আবর্জনা নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছেন। তার জন্য প্রতিটি বাড়িতে একটি করে প্লাস্টিকের বাস্কেটও বিনা পয়সায় দেওয়া হয়েছে। দেখা গেছে, বেশির ভাগ মানুষ বাক্সটি অন্য কাজে ব্যবহার করে বাড়ির আবর্জনা সেই নর্দমায়ই ফেলছে। জলাবদ্ধতা তো হবেই।

চট্টগ্রামের মতো এত অপরিকল্পিত শহর এই অঞ্চলে আর দ্বিতীয়টি আছে বলে মনে হয় না। যত্রত্ত্র মার্কেট, দোকানপাট, লোহালক্কড় অন্য কোনো শহরে দেখা যায় না। বর্তমানে কোথাও কোনো খেলার মাঠ অবশিষ্ট নেই বললেই চলে। এমন একটা জঞ্জালপূর্ণ শহরে জলাবদ্ধতা হওয়া তো অনিবার্য।

চট্টগ্রাম শহরের সমস্যা দূর করা কোনো একজন মেয়রের পক্ষে সম্ভব নয়, যদি না এ শহরের সাধারণ নাগরিকরা তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন না হয়। ১৯৯৫ সালের ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যানে অন্তত ৪টি নতুন খাল নির্মাণ। কয়েকটি জলাধার নির্মাণ, পুরাতন খালসমূহের সংস্কার, প্রশস্তকরণ রয়েছে পাহাড়ের পলিমাটি ধারণের জন্য সিলট্র্যাপ নির্মাণ রয়েছে। কর্ণফুলী নদীর সংযোগ খালের মুখে টাইডল রেগুলেটর নির্মাণও নদীর উভয় তীরে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব রয়েছে ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যানে। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনেগত ০৯/০৮/২০১৭ ইং বুধবারএকনেক এর চেয়ারপার্সন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার নতুন একটি প্রকল্প অনুমোদিতহয়। এ প্রকল্পের আওতায় ১৯৯৫ এরড্রেনেজ মহাপরিকল্পনা অনুযায়ীদ্বৈততা ও পুনরাবৃত্তি পরিহার এবং সমন্বয় সাধনের জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়নকর্তৃপক্ষকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার চট্টগ্রামের ৩৬টি খালের ৫ লাখ ২৮ হাজার ঘনমিটার মাটি খনন, একই সঙ্গে সোয়া ৪ লাখ ঘনমিটার কাদা অপসারণের পরিকল্পনা রয়েছে প্রকল্প প্রস্তাবে। অন্যদিকে ৮৫ কিলোমিটার পাকা রাস্তা নির্মাণ,অর্ধশতাধিক সেতু ও কালভার্ট তৈরি ,বন্যার পানি সংরক্ষণের জন্য তিনটি জলাধারও নির্মাণের কথা ওপ্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে। এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো, শহরের জলাবদ্ধতা দূর করা, খালের পারে রাস্তা নির্মাণের পাশাপাশি খাল পরিষ্কার রাখার স্থায়ী ব্যবস্থা করা; বৃষ্টির পানি দ্রুত নিষ্কাশনের জন্য ড্রেনেজ ব্যবস্থা শক্তিশালী করা। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বৃষ্টি ও জোয়ারের জলাবদ্ধতা থেকে চট্টগ্রাম শহর স্থায়ীভাবে মুক্ত হবে।এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে তখন বোঝা যাবে এ শহরকে বাঁচানোর একটা সম্ভাবনা আছে। না হলে পরবর্তী প্রজন্মকে মানচিত্র দেখিয়ে বলতে হবে একদা এখানে চট্টগ্রাম নামে একটা শহর ছিল, যা কালক্রমে নাগরিকদের উদাসীনতায় লুপ্ত হয়েছে। আসুন, সবাই মিলে শহরটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করি।
কো-অর্ডিনেটর ও শিক্ষক প্রতিনিধি, আগ্রাবাদ সরকারী কলোনী উচ্চ বিদ্যালয়,চট্টগ্রাম

Share on facebook
Share on twitter
Share on whatsapp
Share on print

মন্তব্য করুন

সর্বশেষ সংবাদ