[english_date]

চট্টগ্রামে বাঘের বসতি

মুশফিক হোসাইন

আজ ২৯শে জুলাই পালিত হবে ‘বাঘ দিবস’। বাংলাদেশ, ভারত, রাশিয়া, চীন, মিয়ানমার, জাভা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, নেপাল সহ বিশ্বের অনেক দেশে বাঘ দেখা যায়। তারপরও বাঘ আমাদের জাতীয় প্রাণি। ভারত, নেপালের জাতীয় প্রাণি সিংহ হলে ও পর্যটনের বিকাশের স্বার্থে এখন তারা বাঘকে অন্যতম প্রাণি বলে বিবেচনা করে থাকে। পৃথিবীতে উনিশ শতকে বাঘের সংখ্যা ছিল প্রায় এক লাখ। একবিংশ শতাব্দিতে তা নেমে এসেছে মাত্র চার হাজারে। কত দ্রুত হারে বাঘের সংখ্যা কমে আসছে, তার হিসাব দেখে শংকিত না হয়ে পারা যায় না। যদিও ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এক সময় চট্টগ্রাম, ঢাকা, সিলেট শহর সহ দেশের সর্বত্র বাঘ বিচরণ করতো। এখন তা কমতে কমতে চট্টগ্রাম পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেটে গোটা কয়টি এবং বাকিরা সুন্দরবনে। সর্বশেষ বাঘ শুমারীতে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার বাংলাদেশ অংশে ৪৪০টি এবং ভারতীয় অংশে ২২০টি। ।
বাঘের পায়ের ছাপ চখটএ গঅজক পদ্ধতিতে যে শুমারী হয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। এতে কাদামাটি এবং নরম মাটিতে বাঘের ছাপ ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। ফলে একই বাঘ যে দুই বা ততোধিক বার গণনা যে হয়নি তার নিশ্চয়তা কোথায়। কেউ কেউ ধারণা করছেন এই বাঘের সংখ্যা যথাক্রমে বাংলাদেশে ২২০ এবং ভারতীয় অংশে শতাধিক। সম্প্রতি উন্নত প্রযুক্তির ফটো মনিটরিং পদ্ধতিতে বাঘ গণনার কাজ চলছে। এতে করে বাঘের প্রকৃত সংখ্যা জানা যেতে পারে। কারণ দুটি বাঘ কখনো একই রকম হয় না। দেশবাসী চায় বাঘের প্রকৃত সংখা নিরুপিত হোক।
চীন সহ বিশ্বের কিছু কিছু দেশে প্রচলিত চিকিৎসায় বাঘের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের বিশাল বাজার এখনো আছে। ফলে চোরাশিকারী, সৌখিন শিকারী এবং নগরায়ন ও শিল্পায়নের ফলে বন বনানী পাহাড় ধ্বংসের কারণে মূলত বাঘের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। এক সময় চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও রয়েলবেঙ্গল বসবাস করতো। গাজী আসমত ও এমএমএ হান্নান সম্পাদিত “বাংলাদেশের বন্যপ্রাণি-তালিকা” হতে জানা যায় চট্টগ্রামে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিতাবাঘ, ডোরাকাটা বাঘ, সোনালি বাঘ, মর্মর বাঘ, লাল বাঘ, গেছো বাঘ, মেছো বাঘ, বনবিড়াল, ওয়াব, মোয়াব, খাটাস, বাঘদাশ, লাম চিতা ইত্যাদি বাঘ ও বড় প্রজাতির বিড়াল বাস করতো। গাজী আসমতের নিবন্ধ বাংলাদেশের বন্যপ্রাণির দেড়শত বছরের আগের ইতিহাস এবং জেলা গেজেটিয়ারে একই তথ্য পাওয়া যায়।
হাজার বছরের চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক ইতিহাস থেকে জানা যায়, এখানে ঘন বনবনানি, পাহাড় টিলা নদী হ্রদ খাল বিলে ভরা ছিল। এই প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশে বন্যপ্রাণিদের জন্য ছিল অভয়ারন্য। প্রাচীন চট্টগ্রাম শহরে প্রচুর বাঘ চলাচল ও বসবাসের কারণে এখানে বিভিন্ন অঞ্চলের নাম হয়েছে বাঘকে ঘিরে। উদাহরণত : বাঘঘোনা, টাইগার পাস, বাঘভেলি ইত্যাদি। বিশ্বের অন্য কোন শহরের এলাকার নাম বাঘকেন্দ্রিক আছে কিনা আমার জানা নেই। এতেই প্রমাণ করে চট্টগ্রামে কি পরিমাণ বাঘ ছিল। দক্ষিণ চট্টগ্রামের একটি স্থানের নাম “বাঘগুজরা” অর্থাৎ এখানে বাঘের গর্জন শোনা যেত। আবার ময়মনসিংহে একটি জায়গা আছে “বাঘ বাজার”।
প্রায় ১০০ বছর আগের গেজেটিয়ার থেকে জানা যায় যে, “চট্টগ্রাম ছিল বন্যপ্রাণির অন্যতম উপযুক্ত বাসভূমি। অসংখ্য ও ব্যাপক বন্যপ্রাণির মধ্যে যারা দোর্দ- প্রভাবশালী ছিল, তাদের মধ্যে বাঘ অন্যতম যদিও হান্টার সাহেবের কাছ থেকে চট্টগ্রামের বন্যপ্রাণি সম্পর্কে তার চেয়ে বেশি জানা যায়নি।
চট্টগ্রাম গবেষক আবদুল হক চৌধুরীর তথ্য থেকে জানা যায় (বন্দরশহর চট্টগ্রামগ্রন্থ) বাঘ ভেলু নামে চট্টেশ্বরী রোড ওয়ার সিমেট্রি সন্নিহিত অঞ্চলে একটি এলাকা অবস্থিত। কিন্তু জুরিডিকশন লিস্ট অব দ্য ডিস্ট্রিক চিটাগং ১৯৩০ এ কোতোয়ালী থানার মৌজাসমূহে তার উল্লেখ নেই। তবে চট্টগ্রামের জেলা রেজিস্টারের রেকর্ড রুমে সংরক্ষিত দলিলপত্রের বালামে বাঘভেলু মৌজার সন্ধান পাওয়া যায়। পূর্ণচন্দ্র চৌধুরীর “চট্টগ্রামের ইতিহাস” (১৯২০ সালে প্রকাশিত) গ্রন্থে বাঘ ভেলু এলাকার নাম লিপিবদ্ধ আছে। তার লেখা হতে জানা যায় যে, ঐ এলাকাটি সুউচ্চ পাহাড়ের মধ্যবর্তী একটি উপত্যকা বা সমতল ভূমি। এই বাঘভেলি ছিল বাঘের বিচরণ ক্ষেত্র। এখানে গভীর অরণ্য ছিল। মূলত টাইগার ভেলি বা বাঘ ভেলি আঞ্চলিক ও স্থানীয়দের রূপান্তরিত নাম বাঘভেলু। আবদুল হক চৌধুরী বাঘভেলু নিকটবর্তী এডভোকেট সুনীতি বিজয় হাজারীর উদ্ধৃতি দেন। “প্রাচীনকাল থেকে আমাদের কিশোর সময় পর্যন্ত সুউচ্চ পাহাড় শ্রেণির মধ্যবর্তী গভীর বন-জঙ্গলে আবৃত ছিল, বাঘভেলু স্থানটি। সেখানে দিনে দুপুরে বাঘ গর্জন করে বেড়াতো। সে কালে কাঠুরেরা দলবদ্ধভাবে ছাড়া বাঘের ভয়ে একাকী কাঠ, বাঁশ, ছন ইত্যাদি সংগ্রহে যেত না। তৎকালীন চট্টগ্রাম শহরের অধিবাসীরা সর্বদা বাঘের আক্রমণের ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকতো।” ঐ সময় বাঘের উৎপাত বন্ধ করার জন্য ব্রিটিশ সরকার হতে বাঘ শিকারীদের পুরস্কৃত করা হতো। ফলে ১৮০৭ সালে ২৭০টি বাঘ মারার জন্য পুরস্কার দেয়া হয় সমগ্র বাংলাদেশে। আর ১৯০৭ সালে মারা হয় মাত্র ১৩টি বাঘ। এ সংখ্যা বলে দেয় তৎকালে দেশে কি পরিমাণ বাঘ বাস করতো। যতগুলো বাঘ ঐ সময় ব্রিটিশ সরকারের প্রত্যক্ষ উৎসাহে মারা হয় আজ ২০১৫ সালে দেশে সে পরিমাণ বাঘ আছে কিনা সন্দেহ। (সূত্র প্রথম আলো ১৭ জুলাই ২০১৫)
তৎকালের চট্টগ্রামের কালেকটর এল ক্লে (১৮৬২ইং) লেখেন যে “একদিন দুপুর বেলা খোলা বাজারে বাঘের আক্রমণে একজন নেটিভ (স্থানীয় অধিবাসী) প্রাণ হারায়। সে সময় চট্টগ্রামের জমজমাট বাজার ছিল চকবাজার, দেওয়ানবাজার এবং ফিরিঙ্গীবাজার। তবে চকবাজার ছিল সবচে বেশি জমজমাট। ক্লে সাহেবের অফিস চকবাজারের কাছাকাছি ছিল, হয়তো তিনি ঘটনাটি দেখেছেন। ঐতিহাসিক পূর্ণচন্দ্র চৌধুরী উনবিংশ শতকের শেষ দিকে ফিরিঙ্গীবাজারে বাঘে মানুষ মারার ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন। ব্রিটিশ সরকার প্রথম মহাযুদ্ধের সময় পাহাড়ে বাংলো নির্মাণ শুরু করে। তারাই তখন তাদের সেনাবাহিনীকে নিরাপদ রাখার জন্য চট্টগ্রাম শহরের বনজঙ্গল পরিষ্কারের নামে বাঘ নিধন শুরু করে।
চট্টগ্রামের প্রবীণ ব্যবসায়ী এবং চট্টগ্রাম চেম্বরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ভাইস প্রেসিডেন্ট পরিমল সাহার ছেলে অমূল্য সাহা আমাকে জানান, তার বাবা স্থানীয় প্রবর্তক সংঘ স্কুলে ১৯৪১-৪২ অধ্যয়ন কালে হোস্টেলে থাকতেন। হোস্টেল কর্তৃপক্ষ সন্ধ্যার পর ছাত্রদের হোস্টেল থেকে বের হতে দিতেন না। কারণ বর্তমান মেডিকেল কলেজ, সার্সন রোড, চট্টেশ্বরী এলাকা জুড়ে ছিল পাহাড় আর ঘন বন জঙ্গল। সেখানে ছিল বাঘের বসতি। ছাত্রদের রক্ষা করার জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। মোহরা নিবাসী আমিনুর রশিদ কাদেরীর কাছ থেকে জানা যায় যে, তার দাদা বিশিষ্ট বুজুর্গ হযরত নূর মোহাম্মদ আলকাদেরীর এক মুরীদ একবার তার কাছে একটি বাঘ ধরে এনেছিল। এই কিংবদন্তী প্রমাণ করে তৎকালে চট্টগ্রাম শহরে প্রচুর বাঘ দেখা যেত।
“টাইগার পাস” চট্টগ্রাম শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক। তার আশপাশ এলাকা পাহাড়বেষ্টিত। পাহাড়ি শহর চট্টগ্রামের কয়েকটি রাস্তার সংযোগস্থল। আজ থেকে শত শত বছর আগে ঐ এলাকা গভীর জঙ্গলে আবৃত ছিল। ছিল জনবসতিহীন। সেখানে দিনে দুপুরে বাঘ চলাচল করতো। চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকার বাঘ এইপথে চলাচল করতো বলে ব্রিটিশরা এর নামকরণ করে টাইগার পাস। লিভ্স ফ্রম এ ডায়রি ইন দ্য লোয়ার বেঙ্গঁলে” লেখেন “চট্টগ্রাম তখন ছিল জঙ্গঁলাকীর্ণ। দিনদুপুরে বাঘের গর্জন শোনা যেত”। তিনি বাঘের আক্রমণে মানুষ মৃত্যুর কথা উল্লেখ করেন।
তৎসময়ে চট্টগ্রামের আর একটি এলাকার নাম ছিল “লেপার্ড পাস”। ক্লে সাহেবের বিবরণী থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়। চিতাবাঘের উৎপাতের জন্য এ স্থানটি ছিল বিখ্যাত। বর্তমানে এ অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। হয়ত কালের বিবর্তনে অন্য নাম নিয়েছে। “বাঘঘোনা” নামে চট্টগ্রামে আর একটি স্থান আছে। লালখান বাজারের টিলা ও পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে সমতল ভূমির নাম বাঘ ঘোনা। যা ঝাউতলা ওয়ারলেস কলোনী পর্যন্ত বিস্তৃত। বিংশ শতাব্দির তিন দশক পর্যন্ত এখানে ঘন জঙ্গলে আবৃত ছিল। এ এলাকায় বাঘ বিচরণ করতো বলে বাঘঘোনা নামে পরিচিত হয়। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ঘোনা মানে বসতি। উদাহরণত চিংড়িঘোনা, মানে চিংড়ি আবাদ। এখানে বাঘের বসবাস ছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ভারতের বিহারী শরণার্থীরা এতদাঞ্চলে বাস করতে থাকে।
চট্টগ্রামের পাহাড় বন বনানী এখন আর নেই। চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশে যে সকল বন্যপ্রাণি অবশেষে টিকে ছিল। বৃটিশরা নেটিভ খৃস্টান দের হাতে অস্ত্র দিয়ে তাদের শিকার করতে উৎসাহ দিত। আমাদের শৈশবে দেখেছি যে এই আংলো খৃস্টান তথা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় মাইট্ট্যা ফিরিঙ্গীরা ছুটির দিনে উৎসব করে শিকারে বের হতো। খরগোস, বন্যছাগল, হরিণ,শুকর, বনমোরগ তো শিকার করতোই। সাথে সাথে তারা তাদের নিরাপত্তার জন্য বাঘ, ভালুক, গন্ডার নির্বিচারে শিকার করতো। আমাদের শৈশবে খৃস্টান বন্ধুদের কারো কারো বাড়িতে বাঘের চামড়া শো পিছ হিসেবে দেখেছি। এছাড়া চট্টগ্রামের বিত্তবানদের কারো কারো দহলিজেও বাঘের চামড়া দেখেছি।
চট্টগ্রামে বাঘ তথা বিড়াল প্রজাতির অনেকে এখনো শহর ও শহরতলীর বনে জঙ্গল টিকে আছে। মোয়াপ খাটাশ, মেছোবাঘ, বন বিড়ালের দেখা মেলে। চট্টগ্রামের লোকাল ও ধর্মীয় সংস্কৃতিতে বাঘের উপস্থিতি জানা যায়। প্রসিদ্ধ মাইজভান্ডার তরিকার বুজর্গ হযরত গোলামুর রহমান মাইজভা-ারি বাঘের পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়াতেন। শেরে চাটগাম কাজেম আলি মাস্টারের কথা অনেকেই জানেন। সুন্নী তরিকার বিশিষ্ট আলেম আব্দুল আজীজ শেরে বাংলা নামে খ্যাত ছিলেন। কবিয়াল রমেশ শীলের গানে, চট্টগ্রামের প্রবাদেপ্রবচনে বাঘের উপস্থিতি লক্ষণীয়। “চাঁটিগাঁ আইলে বাঘের বল বাড়ে” চট্টগ্রাম সেনানিবাসের যাদুঘরে আমি ড. ক্বামার বানু, নুরুল হুদা রাশেদা বেগম সহ বাঘের চামড়া দেখেছি।
পরিশেষে বলা যায়, চট্টগ্রামের শহর ও শহরতলী বনে জঙ্গলে একসময় বাঘের রাজত্ব ছিল। সে ইতিহাস হয়ত চট্টগ্রামবাসী এবং প্রাণি বিজ্ঞানিদের অনেকেই বিস্মৃত। চট্টগ্রামের ইতিহাস লেখক, পর্যটক, গেজেটিয়ারে তথ্যে, স্মৃতি কথায় তা জানা যায়। চট্টগ্রাম যেমন ব্যবসা বাণিজ্য, ধর্মপ্রচার, মর্গ জলদস্যুতার জন্য বিখ্যাত। তেমনি এখানের বন্যপ্রাণির জন্য বিশেষ করে বাঘের জন্য বিখ্যাত ছিল। কর্ণফুলী যেমন চট্টগ্রাম শহরকে জড়ির ফিতার মতো জড়িয়ে রেখেছে, তেমনি বাঘঘোনা, টাইগার পাস, টাইগার হিল ইত্যাদি নাম বাঘের স্মৃতি নিয়ে জড়িয়ে আছে। চট্টগ্রামের বাঘের ইতিহাস উদঘাটন আবশ্যক।

লেখক : কবি, নিসর্গী ও প্রাক্তন ব্যাংকার।

Share on facebook
Share on twitter
Share on whatsapp
Share on print

মন্তব্য করুন

সর্বশেষ সংবাদ