‘চলচ্চিত্রের কিছু ক্রিমিনালের গাফিলতিতে বাংলা নাটকের কতবড় ক্ষতি হয়ে গেল সেটা কি চলচ্চিত্রের অভিনেতৃবৃন্দ কোনোদিন বুঝবেন? এ যেন নাট্যকর্মীদের বৃহত্তর আত্মহত্যার প্রতীক।’ – কেয়া চক্রবর্তীর মৃত্যুতে এভাবেই ঝলসে উঠেছিলেন উৎপল দত্ত। বস্তুত এ আফশোস তাঁর একার নয়, কেয়া চক্রবর্তী বাংলা থিয়েটার জগতের এক মিথ হয়ে ওঠা দীর্ঘশ্বাস। তাঁর আকস্মিক প্রয়াণ, দুর্ঘটনায় নাকি তা হত্যা, সে কিনারা আজও হয়নি। কিন্তু বাংলা নাটকের পরিবারে বারেবারে ফিরে এসেছে তাঁর উজ্জ্বল স্মৃতি। সে স্মৃতি ফিরছে সিনেপর্দাতেও। নাট্যপরিচালক দেবেশ চট্টোপাধ্যায় তাঁর প্রথম ছবি ‘নাটকের মতো’তে ফিরিয়ে আনছেন কেয়া স্মৃতি, খেয়ার আদলে। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে ছবির ট্রেলর।
সিনেমার আগে কেয়া চক্রবর্তীকে নিয়ে আরও কাজ করেছেন দেবেশ। তাঁরই সম্পাদনায় কেয়া চক্রবর্তীকে নিয়ে একটি সম্পূর্ণ সংকলন-‘কেয়া’ প্রকাশিত হয়েছিল কিছুদিন আগে। মুখবন্ধে সম্পাদক জানিয়েছিলেন, কেয়া চক্রবর্তীর মৃত্যুর ১৮ বছর পর প্রকাশিত হয়েছিল ‘সংসৃতি’র বিশেষ কেয়া চক্রবর্তী সংখ্যা। তারও আগে চিত্তরঞ্জন ঘোষের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘কেয়ার বই’। দেবেশের সংকলনে সব মিলিয়ে বহু মূল্যবান স্মৃতিচারণ ও লেখা গ্রন্থিত ছিল। আর তাতেই একটু একটু করে ফুটে উঠেছিল প্রয়াত অভিনেত্রীর অবয়ব। ফুটে উঠেছিল তাঁর মৃত্যু ঘিরে থাকা রহস্য, আক্ষেপের স্বর। ‘জীবনের একটা চূড়ান্ত মুহূর্তে যে-মেয়ে সব ছেড়ে একটা আশ্চর্য টেক-অফ করতে চেয়েছিল, তার সেই ডানা মেলার মুহূর্তেই মৃত্যু ছিনিয়ে নিয়ে গেল তাকে’- এ দীর্ঘশ্বাস কবিতা সিংহের। জগন্নাথ বসু জানাচ্ছেন, ‘ একদিন ‘আন্তিগোনে’ নাটকের শেষে গ্রিনরুমে গিয়ে দেখি, কেয়াদি আন্তিগোনের পোশাকটা পরে আছেন, খুলছেন না। জিজ্ঞেস করতে একটু হেসে বললেন, যতক্ষণ পরে থাকা যায়। ইংরেজির অধ্যাপিকা, ভালো অভিনেত্রী, গভীর মনন সব মিলে কেয়াদি ছিলেন এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।’ এ চাকরিও তিনি নাটকের জন্যে ছেড়ে দিয়েছিলেন। নিজে হাতে ‘নান্দীকার’-এর বিজ্ঞাপন তৈরি করতেন। নানাজনের স্মৃতিতে ভেসে আসে তাঁর দরদী, আবেগী মনের কথা। কাউকে অর্থসাহায্য করতে হলে কখনও গুণেও দেখতেন না। মেঘনাদ ভট্টাচার্য যেমন লিখেছেন, ‘ একজন শিল্পীর যেটা মূলধন –সিস্মোগ্রাফের মতো অসম্ভব সংবেদনশীল ছিল তাঁর মন। যে মনে আপাত সাধারণ ঘটনাও তুলত অনুরণন, অন্যের সামান্য কষ্টে তিনি হতেন অসম্ভব বিচলিত।’
নানাজনের স্মৃতির আখরে যে ছবি তৈরি হয়েছিল তা এবার ধরা পড়বে ছায়াছবিতেও। কেয়া চক্রবর্তীর ভূমিকায় ছবিতে দেখা যাবে পাওলি দামকে। যদিও এ ছবি বায়োপিক নয়। ছবিতে এ চরিত্রের নামও খেয়া। অন্যান্য চরিত্রগুলোও নামে আলাদা, তবে তা চিনিয়ে দিতে পারে নাট্যজগতের পরিচিতজনদের। নামের তফাত থাকলেও এ ছবি কেয়া চক্রবর্তীর জীবনের ঘটনা আধারিতই। অন্যান্য চরিত্রে ছবিতে আছেন ব্রাত্য বসু, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, সুজন মুখোপাধ্যায়, রজতাভ দত্ত, ঊষসী চক্রবর্তী প্রমুখ। থিয়েটারের মতো, থিয়েটার কর্মীও বেঁচে থাকেন স্মৃতিতে ও শ্রুতিতে। সেই দুয়ের মেলবন্ধনেই আজকের সময়ে কেয়া চক্রবর্তীর মতো একজন আদ্যন্ত থিয়েটার কর্মীকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। দেবেশের এ ছবিও হয়তো তারই খোঁজ দেবে। ‘কোনও কোনও দুর্ঘটনা হয়তো আত্মহত্যা, কিন্তু প্রতিটি আত্মহত্যাই আসলে হত্যা’- এ সিদ্ধান্ত সঠিক কি না কিংবা নাট্যজগতের অন্দরে পড়া অভিশাপের কালো ছায়াকে আজ আর তেমন স্পষ্ট করে চেনা যাবে কি না- বড় কথা তা বোধহয় নয়। বরং এই ছবি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে আরও বৃহত্তর প্রেক্ষিতে। ছবিমুক্তি ২১ অগাস্ট।