সরকার পতনের একদফা দাবিতে ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। দলটির দাবি, এ সমাবেশ থেকেই সরকার পতনের মহাযাত্রা শুরু হবে। এতে বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হবে ৩৬টির বেশি রাজনৈতিক দল। অন্যদিকে, এদিন রাজপথ দখলে রাখার হুঁশিয়ারি দিয়েছে আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন। এক্ষেত্রে বিএনপি আসলে কী করতে যাচ্ছে এবং আওয়ামী লীগই বা কী ভাবছে – এমন প্রশ্নই এখন জনসাধারণের মনে।
গেল ১৮ অক্টোবর রাজধানীর নয়াপল্টনে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে জনসমাবেশ করে বিএনপি। ওই সমাবেশের মধ্যদিয়ে শেষ হয় ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া বিএনপির কর্মসূচি। চলমান কর্মসূচির শেষ দিনে দলটির নেতাকর্মীদের প্রত্যাশা ছিল ব্যাপক। অনেকেই আশাবাদী ছিলেন শেষ দিনের এ কর্মসূচি থেকে আসতে যাচ্ছে সরকার পতনের বড় কোনো ঘোষণা। কিন্তু সেটি পূরণ করতে পারেনি দলটি। কেননা আবারও বিএনপি ১০ দিনের ব্যবধানে ঘোষণা দেয় সমাবেশের।
এদিন প্রধান অতিথি হিসেবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বক্তব্য দেন এবং পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি আগামী ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশের ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘এই মহাসমাবেশ থেকে সূচনা হবে সরকার পতনের মহাযাত্রা; এরপর আর থেমে থাকব না আমরা।’
এরই মধ্যে ২৮ তারিখের এ কর্মসূচি রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। কেননা একই দিন ঢাকায় সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন। আওয়ামী লীগ নেতারা একদিকে যখন রাজপথ দখলে রাখার হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন, অন্যদিকে সরকার পতনের দাবিতে মহাসমাবেশকে সফল করতে জোর প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলো।
দুপক্ষের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ঘিরে এদিন রাজধানীতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন।
গত ২৩ অক্টোবর সচিবালয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেন স্বাভাবিক থাকে, জনজীবন যাতে ব্যাহত না হয়, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বলেছি। জেলা প্রশাসকদেরও এ বিষয়ে বলা হয়েছে।’
কেমন চলছে বিএনপির প্রস্তুতি?
আগামী ২৮ অক্টোবর ঢাকায় স্মরণকালের সবচে বড় জনসমাগম ঘটাতে চাচ্ছে বিএনপি। দলের নেতারা বলছেন, সমাবেশ সফল করতে মহানগরের সমন্বয় কমিটিগুলো জেলার সঙ্গে সমন্বয় করছে; এমনকি প্রতিটি জেলা থেকে অধিকসংখ্যক নেতাকর্মী ঢাকায় আনার কথা বলা হয়েছে দায়িত্বশীল নেতাদের। একাধিক নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মামলা, হামলা ও ধরপাকড় এড়ানোর জন্য হাই কমান্ডের নির্দেশ অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নেতাকর্মীরা এরই মধ্যে ঢাকায় আসা শুরু করেছেন।
কী করতে যাচ্ছে বিএনপি?
সরকার পতনের দাবি আদায়ে কখনও সমাবেশ, কখনও পদযাত্রা, কখনো বা রোডমার্চ করেছে দলটি। এবার ১৮ অক্টোবরের সমাবেশ থেকে ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশের ডাক দেয়া হয়েছে। এই মহাসমাবেশের মধ্যদিয়েই সরকার পতনের মহাযাত্রা শুরু করবে দলটি – এমনটিই বলছেন নেতারা।
গত ২১ অক্টোবর সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, একদফা দাবি আদায়ে মহাসমাবেশ করার প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ স্থায়ী কমিটির নেতারা উপস্থিত ছিলেন। একই সঙ্গে দলটির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারাও অংশ নেন। এ সময় লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চুয়ালি অংশ নেন এ বৈঠকে।
এর একদিন পর গত ২২ অক্টোবর নয়াপল্টন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যৌথসভা শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ২৮ তারিখ কর্মসূচি হবে শান্তিপূর্ণ। কর্মসূচি শেষে সবাই যার যার জায়গায় চলে যাবে আবার। এমন কোনো কর্মসূচি দেয়া হবে না, যেখানে বসে পড়তে হবে। সমাবেশ সফল করতে সারা দেশ থেকে জনগণ আসবে ২৮ তারিখ।
এবারের আন্দোলন বিজয়ের দিকে যাচ্ছে, সফলতার দিকে যাচ্ছে, এমনটা জানিয়ে গতকাল (২৪ অক্টোবর) গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব বলেন,
একদফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আমরা ২৮ তারিখ কর্মসূচি দিয়েছি। সেদিন অনেক রাজনৈতিক দলও কর্মসূচি দিয়েছে। আওয়ামী লীগের কর্মসূচি দেয়ার অধিকার থাকলে, জামায়াতসহ সবারই কর্মসূচি দেয়ার অধিকার আছে। প্রায় ৪০টি দল কর্মসূচি দিয়েছে।
বিএনপির ২৮ অক্টোবরের কর্মসূচিসহ আরও নানা বিষয়ে সময় সংবাদের কথা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক শামসুল আলম সেলিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ২৮ তারিখে যে কর্মসূচি, সেটি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ একটি কর্মসূচি। বিএনপি তার বিগত রাজনৈতিক কর্মসূচির মতো এটিও শান্তিপূর্ণভাবে করবে বলেই মনে হচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগ যে পাল্টাপাল্টি সমাবেশ দিয়েছে, তাতে জনসাধারণের মধ্যে ভয় তৈরি হয়েছে। আওয়ামী লীগ যদি কোনো উসকানি না দেয় এবং বাধা না দেয়, তবে ২৮ তারিখ শান্তিপূর্ণভাবেই সমাবেশ শেষ হবে।
তিনি আরও বলেন, বিএনপি সংঘাত-সহিংসতায় বিশ্বাসী নয়। তবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যদি কোনও বাধা আসে, তবে এবার বিএনপি ছাড়া দেবে না। বাধা আসলে বিএনপি সেখানে বসে পড়বে। ১০ ডিসেম্বর আর ২৮ অক্টোবর কোনোভাবেই এক না। এবার মামলা, হামলা আর নির্যাতনে বিএনপির নেতাকর্মীদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। তাই এবার জনসাধারণকে নিয়ে ঢাকায় ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জনসমাগম ঘটাতে যাচ্ছে বিএনপি।
রাজপথে থাকবে জামায়াতও
আগামী ২৮ অক্টোবর রাজধানীর শাপলা চত্বরে শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। ২৩ অক্টোবর জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের এক সভায় এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন,
গোটা জাতি আজ এক দফার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ। এমতাবস্থায় সংসদ ভেঙে দিয়ে পদত্যাগ করে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ আগামী ২৮ অক্টোবর রাজধানী ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা করছে। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জামায়াতে ইসলামীর সর্বস্তরের জনশক্তি ও দেশবাসীকে সুশৃঙ্খলভাবে অংশগ্রহণ করার জন্য নির্বাহী পরিষদ আহ্বান জানাচ্ছে।
রাজপথে বিএনপির সঙ্গে একই দিনে জামায়াতের কর্মসূচির ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই যেন জনমনে সংঘাত-সহিংসতার ভয় আরও প্রকটতর হচ্ছে। তবে জামায়াত নেতাদের দাবি, তারা ২৮ তারিখ শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি করতে যাচ্ছে।
কী ভাবছে আওয়ামী লীগ
আগামী ২৮ অক্টোবর ঘিরে বিএনপি যেন সহিংস কর্মকাণ্ড করতে না পারে, যেজন্য রাজপথ দখলে রাখার কথা বলছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। তাদের ভাবনা, বিএনপি ঢাকায় সহিংস কর্মকাণ্ড করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাই বিএনপিকে মোকাবিলার লক্ষ্যে এদিন ঢাকায় বিশাল শান্তি সমাবেশে জনসমাগম ঘটাতে চায় আওয়ামী লীগ এবং এর বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন।
বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের দক্ষিণ গেটে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের আয়োজনে শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। এর মধ্যে সমাবেশের অনুমতি চেয়ে ডিএমপির কাছে চিঠিও দেয়া হয়েছে। সমাবেশে লোকসমাগম ঘটাতে দফায় দফায় বৈঠক করছে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ সময় সংবাদকে বলেন, ‘আমরা মাঠ ছেড়ে দেব না। কেউ খালি মাঠে গোল দিতে পারবে না। বিএনপি যদি মনে করে যে, তারা মহাসমাবেশ করবে, তো ওই একই জায়গায় করতে পারবে।
গত ২৪ অক্টোবর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিশেষ বর্ধিত সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন,
আওয়ামী লীগ সব সময় শান্তি চায়। আওয়ামী লীগ শান্তি না চাইলে বিএনপি একটা সমাবেশও করতে পারত না।
বিএনপি আবারও ভুল পথে হাঁটছে। দিনক্ষণ দিয়ে কোনো সরকারের পতন হয় না। যারা দিনক্ষণ দিয়ে আন্দোলনের ঘোষণা দেয়, তাদের আন্দোলন খাদে পড়বে বলেও এ সময় মন্তব্য করেন ওবায়দুল কাদের।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, ঢাকা আওয়ামী লীগের অধীনেই থাকবে। কোন অপশক্তিকে মাঠ ছেড়ে দেবে না। সদরঘাট থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত দখলে রাখবে আওয়ামী লীগ। মাঠ দখলের প্রস্তুতি নিয়ে আসতে দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেন তিনি।
পুলিশের অবস্থান
আগামী ২৮ অক্টোবর রাজধানীসহ সারা দেশে যেন কোনো প্রকার সহিংসতা না হয়, সে জন্য কঠোর অবস্থানে থাকার কথা জানিয়েছে পুলিশ। সমাবেশকে কেন্দ্র করে আগামী চার-পাঁচ দিন বিএনপির মধ্যম সারির নেতাদের দিকে নজরদারি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ। পাশাপাশি সমাবেশের দিন পুলিশ সদস্যদের মাথা ঠান্ডা রেখে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
এ কর্মসূচি ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থাকবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।
সোমবার (২৩ অক্টোবর) গণমাধ্যমকে তিনি বলেন,
নির্বিঘ্নে ২৮ তারিখ বিএনপি মহাসমাবেশ করতে পারবে। তবে যে কোনও ধরনের নাশকতার ব্যাপারে সর্বদা সজাগ রয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
হারুন অর রশীদ বলেন, ‘আগামী ২৮ তারিখের সমাবেশ ঘিরে কোনো নাশকতার আশঙ্কা নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থাকবে। অতীতের মতোই শান্তিপূর্ণ সমাবেশ হবে বলে আশা করি।’
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘রাজনৈতিক দল তাদের সমাবেশ করবে – এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিষয় আমরা দেখব। সেই সঙ্গে কেউ যাতে জনগণের সম্পত্তি বিনষ্ট করতে না পারে, সেটাও দেখব।’
দেশে বর্তমানে কোনো প্রকার জঙ্গি হামলার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা চুপচাপ বসে নেই। আমাদের কাজ চলমান। যে কোনও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রস্তুত ডগ সুইপিং স্কোয়াড ও হেলিকপ্টার।’