প্রকাশকাল- একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৬
প্রকাশনা – শাঁখ
প্রচ্ছদ – নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
পুষ্প প্রসবার জলচোখ
চা মুড়ির সকাল ছিল আমাদের। তারপর আলিফ যবর আ, সাহস ছিল না এতটুকু, হুজুরকে কখনো বলতে পারিনি। বা যবর বা না হয়ে বে কেন? এ রকম অসংখ্য ভুলে ভরা ছিল পাঠশালা জীবন। বর্গীয় ‘জ’ কে বইরগার জ বলতাম আমরা। স্কুল-শিক্ষক শেখাতে পারেনি কিছুই। নামের পরে যোগ চিহ্ন টেনে কতজন লিখে গেছে কত নাম। কেউ আমাকে শেখাতে পারেনি, কিভাবে ভালবাসতে হয়। অথচ আমার পদ্মদিঘি মা কোন ভুল করলে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলতো। আর আমি শিখেছিলাম বারবার ভুল করা মানুষকেও ভালবাসা যায়। আজো ভুল করা মানুষের জন্য বাঁচি। মাঝে মাঝে হাঁটুমুড়ে বসি ঈশ্বরের পায়ের কাছে। নতজানু কান্নায় ভাসিয়ে দিই সবুজ জায়নামাজ। মা আমার শিক্ষক, আমার আলো।
পিতা অতঃপর কবিতা
বাবার মৃত্যুর পর আতর লোবানে ভরেছিলো ঘর।
আপু বলেছিল, বাবা পাখি হয়ে যাও
ঠিক ভোরের দোয়েল
বারবার উড়ে এসো আমাদের তৃষ্ণার্ত জানালায়।
নির্বাক আমি। জলে ভেজা চোখের কোটর ঘেঁষে
মায়ের আর্তনাদ-
অঞ্জলি ভরা হাসনাহেনা দিয়ে বলেছিলে- গেঁথে নাও।
তবে এবার তুমি হও নয়নতারা
আমি গেঁথে নিবো সব মালা।
ভাইয়া গুরুগম্ভীর, এবার সপ্তর্ষি হও বাবা
রাত জেগে ছুঁয়ে দিবো তোমায়।
দাদি বলেছিলো বাবারা মারা গেলে
ঋষি হয়ে যায়। স্কুল ফাঁকি দিয়ে ভূতের ভয় কাঁধে নিয়ে
বারবার ছুটে গেছি ছাতিম তলায়।
নাহ- বাবা ঋষি হয়নি।
মৃত্যুর তেরো বছর পেরিয়ে গেছে
বাবা ফুল পাখি কিছুই হয়নি।
শুধুই কবিতা হয়েছে আজ।
আতরগন্ধী শ্লোক
আজ আর কোন কিছু কঠিন মনে হয় না
নিমেষে তোমার মুখে ঠেলে দিতে পারি
আটাশ বছরের পুরোনো বিষ।
নিরাপত্তার প্রটোকলে ভীষণ অনিরাপত্তা চেয়ে বসি
খুব ইচ্ছে করে
কেউ একজন খুন করে যাক আমার ভেতরটায়।
বারবার এঁকেছি রোদের পাখি
ছায়ার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে।
জমিতে যতবার দিয়েছি শান
ততবার আকাশে জমেছে মেঘ।
ভিজেছে শহরের বিষণ্ণ আস্তিন।
অবারিত আঁধারে মাদুর পেতে খুঁজেছি আধখ- চাঁদ
শুধুই ভালোবাসবো বলে
আতরগন্ধী শ্লোকে সাজিয়েছি রুমাল
কে বা এসেছে কাছে?
না-মানুষ না-ঈশ্বর
আমি দ্বৈত প্রাণ ছুঁয়ে দেখেছি
মানুষ বা ঈশ্বর কেউ ভালবাসতে জানে না।
পানশালার চর্যাপদ
একটি পুরাণ আজো শুনিয়ে যাই
শেষ যতি চিহ্ন পর্যন্ত
বুকের মাঝে বড় যত্নে আঁকি
জোনাকির স্বপ্ন।
জলের দর্পণে বার বার দেখা
বদলে যাওয়া মুখ-
ভোরের প্রার্থনায় কান চেপে বলেছে
উর্দু চাই না আর
বোবা মেয়ে কেঁদেছে শুধু!
পানশালায় ফেলে আসা চর্যাপদ অথবা
আঁচল-গহীনে দেখে লুকানো অক্ষর।
গল্পটা আজ আর সেদিনের বুলেট নয়
নয় থেতলে যাওয়া পোড়া মাংস।
অসহায় কাবুলিওয়ালা আমি
স্মৃতির মিনার ছাড়া কিছুই নেই গল্পের ঝুলিতে।
অনামিকার সংসার
জল টুপটুপ চোখে অনামিকা কাঁদেনি
আটপৌরে আঁচলে লুকিয়েছে শুধুই বাসন্তি রঙ।
শাঁখা-সিঁদুরের কাগুজে দলিল
কেড়েছে কৃষ্ণপক্ষ রাত।
কামিনির জাদুচ্ছলে বাঁধা বেণী
পুড়েছে পশ্চিমাকাশ।
অনামিকা কোন নারী নয় আজ
অথৈ সমুদ্র চোখে দক্ষ নাবিক।
আমাদের টিকটিকি জীবন
কোন এক সন্ধ্যায় আবছা আঁধার দেখে
অস্তগামী সূর্যের সাথে ডুব দিয়েছিলাম।
কী ভুলে জানি সকাল ভেবে চোখ মেলে দেখি
তখনও কাটেনি রাত।
বছরের পর বছর গেল
আমাদের ঘুম ভাঙানিয়া পাখিরা
ডাকেনি আর।
কব্জির নিচে যতটা সময় জমা রেখেছি
সবটা ফুরিয়ে গেলে নড়ে চড়ে উঠে শরীর
শিরা উপশিরা খুলে দেখি
রক্তগুলি ধবধবে সাদা
কোথাও পানির মত বর্ণহীন।
পানি-রক্ত গায়ে আমি আজ
দেয়াল ঘেঁষা টিকটিকি
আলো দেখলে পালাই আঁধারে
গুটিঁয়ে গেছে হাতের আঙুল
অহেতুক রক্তপাতেও
উঠে না তর্জনী।
ছবি
ক্যানভাস ছুঁয়ে মনের গলিতে
যতবার আঁকি, সহস্রবার তুমি দুর্ভেদ্য
শরবিদ্ধ শব্দে অনাহুত কবিতার ঢেউ
তেতো শরীরে আঁকে নোনা চুমুর কারুকাজ।
সুঁইয়ের খোঁচায় টের পাই
বদলে গেছে বল্কল সভ্যতা।
দ্রবণ থেকে সংগোপনে আলাদা করা
নিঃসঙ্গ দ্রব দ্রাবক বিতর্কহীন।
আঁকছি শুধু
কখনো আলো, কখনো বা আঁধার
যেন ক্লান্ত পিথাগোরাস
কাঠ পেন্সিলে ধূসর, রঙ পেন্সিলে রঙিন।
ভোর হয় তবু হয় না সকাল
লেগেছে দাবানল দূর আমাজানে
তারই কিছু আহ্লাদী হাওয়া
আমাদের ডানপিঠে শহরে।
গোড়ালি গুহায় জমা রেখে পা
মানুষেরা হয়েছে সরীসৃপ।
জলঘাটে কানাকানি করা জোছনা দেখি না আর।
‘শুভ সকাল’ বলবে ভেবে যে এলোকেশী
দাঁড়িয়েছিলো গন্ধরাজ হাতে,
সেও ভাসছে হাওয়ায়, ছুটছে সময় রথে।
হাতের তালুয় দোলাচ্ছে জলসা ঘর।
মাঝে মাঝে জাগে শিরদাঁড়া
আবার ভেসে যায়
কুকুরে চেটে খায় রক্তজবা প্রাণ।
জেগে জেগে ঘুমিয়ে আছে এ শহরের পাখিরা
প্রতিদিন ভোর হয় তবু আসে না সকাল
জাগে না কেউ আর….
না-পাখি না-মানুষ।
মানুষ পুড়লেই মানুষ
বোধি বৃক্ষের ছায়া মাড়াইনি
ক্রুশ বিদ্ধ যিশু নই….
তবু সূর্যের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে গলি মোম হয়ে
হে ক্ষুধিত মাটি, মানুষের গলিত লাভায়
এবার ফোটাও সূর্যমুখী।
চাষে লাঙল, সোনা রঙে কৃষাণীর গোলা।
প্রতিবেশী তারাদের কানে বলে দাও
মেঘের অনশনে বৃষ্টি নয়
মানুষ পুড়লেই বৃষ্টি হয়।
মানুষের অঙ্গারে গড়ে সভ্যতা
শুনো হে জাগ্রত পৃথিবী, ধূলিকণা
মানুষ জাগলে কিছুই লাগে না
মানুষ জাগলে রাজপথে মিছিল, স্লোগান।
মানুষ জাগলেই মানুষ
মানুষ পুড়লেই মানুষ!
মানুষ বাজলে বাজে না সুর
স্মৃতির দরজায় উঁকি দিয়ে দেখি
এখনও কেমন তুমুল বাজাও অর্গান
জলসা-কাঁপা শীতে জড়িয়ে নিই আদিম চাদর।
অথচ তোমাকে ভায়োলিন দিবো বলে
রুদ্ধশ্বাসে নিয়েছি মেঘমুদ্রার জবানবন্দি।
পাখি পিঠে পারিজাত পেতে দেখেছি
ভালোবাসা টুকরো টুকরো কার্পেট,
ইশারায় ঘুরে যাওয়া লাটিম জীবন।
তোমার হাতে বাঁশি নাই
তবু আমি নেচে যাই নগ্ন পায়ে,
শূন্য ঠোঁটে কেমন বাজাও
আমার ভেতর বাহির।
মানুষ বাজলে বাজে না সুর
অথচ জল বাজলে মাতাল আকাশ পাতাল
মেঘমুদ্রা জলে মাছেদের সঙ্গমে তুলি সুর।