কবি জিললুর রহমান আশির দশক হতে কবিতার সাথে পথ চলছেন । নব্বই দশকে চট্টগ্রাম সবুজ হোটেল হতে উত্তর আধুনিক কবিতা আন্দোলনের অন্যতম অংশীদার তিনি। “লিরিক” ছোটকাগজ সম্পাদনার সাথে কাজ করেছেন। প্রকাশিত দুটি কবিতার বই “অন্যমন্ত্র” ও “শাদা অন্ধকার”। এছাড়াও উত্তর আধুনিক চিন্তা নিয়ে লিখেছেন প্রবন্ধ “উত্তর আধুনিকতাঃ এ সবুজ করুণ ডাঙায়”। রয়েছে একটি অনুবাদ গ্রন্থ। কবিতা বিষয়ক কিছু প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আর্থনিউজ২৪ এর সাথে কথা বলেছেন কবি জিললুর রহমান।
আর্থনিউজ২৪ : কেন কবিতা লিখেন?
জিললুর: এ ধরনের অবান্তর প্রশ্ন দিয়ে আলোচনা শুরু করার কি কোনো মানে আছে? কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে তাই কবিতা লিখি। শৈশব থেকে কবিতা ভালো লাগে, পড়তে ভালো লাগে, শুনতে ভালো লাগে, লিখতে ভালো লাগে। ভালো লাগার আবার কারণ খুঁজতে চাইবে না তো?
আর্থনিউজ২৪ : কবিতা কী সবার জন্য, যদি সবার জন্য না হয়, তাহলে সবার জন্য নয় কেন?
জিললুর: কেন নয়। সবাই কবিতা পড়েই তো বডো হয়। সবাই লিখলেই বা ক্ষতি কি? তবে যাদের ভেতরে মনুষ্যত্ব নেই, মন নেই, তাদের হয়তো কবিতা ভালো না-ও লাগতে পারে। তবে তাদেরও কবিতা পাঠ চিকিৎসা পথ্য হিসেবে দিতে পারো।
আর্থনিউজ২৪ : সাম্প্রতিক কবিতার যে দুর্বোধ্যতা এই বিষয়কে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
জিললুর: এটা খুব জটিল প্রশ্ন। এতে কয়েকটি বিষয় রয়েছে। কবিতার দুর্বোধ্যতা, সাম্প্রতিক কবিতা, আমার মূল্যায়ন। কবিতা যে পড়ে, তার কাছে কবিতা কি দুর্বোধ্যতা দোষে দুষ্ট? নাকি, যে কবিতা পডে না, কবিতা ভালেবাসে না, তার কাছে কবিতার দুর্বোধ্যতা? দুটোর ক্ষেত্রে মূল্যায়ন দু’রকম হতে বাধ্য। এবার এসো, সাম্প্রতিক বলতে তুমি কোন তারিখ থেকে বলছো? তথাকথিত দশক বৃত্তে হিসেবে? নাকি স্বাধীনতা উত্তর? নাকি তিরিশ দশক? রবীন্দ্রনাথ এর সময়ে? নাকি মাইকেল? দিজেন্দ্রলাল? মহাকালের বিচারে তো চর্যাপদের কবিতাও সাম্প্রতিক। পাঠ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে না গেলে সব কালের সব কবিতাই দুর্বোধ্য। এবার আমার মূল্যায়ন প্রসঙ্গ। আমি মনে করি, একজন সত্যিকার কবিতার পাঠক যা বুঝে না, তা কবিতা পদবাচ্য কিনা দশবার ভাবতে হবে বৈকি!
আর্থনিউজ২৪ : সাম্প্রতিক তরুণ কবি ও অগ্রজ কবিদের মধ্যে কি রকম কবিতা-পার্থক্য লক্ষ্য করেন?
জিললুর: আবারও বিপত্তিতর প্রশ্ন। সাম্প্রতিক, তরুণ কবি, অগ্রজ কবি — এ সব কি অর্থ ধারণ করে? আমার অবস্থান কোথায়। আমি কি তরুণ নেই? প্রকৃত কবিতার মূল মন্ত্র হচ্ছে `অন্তর বাজে তো, যন্তর বাজে’। যা হৃদয়ে টঙ্কার তোলে না, তা কবিতা নয়। তবে কবিতা সময়, পরিপার্শ্ব, সমাজচেতনা, সংস্কার ইত্যাদির কারণে নিয়ত রূপ বদলায়, ভাষা বদলায়, ফর্মও বদলায়। সে আঁচড় কবিতায় প্রতিদিনই পড়ছে।
আর্থনিউজ২৪ : বর্তমানে যে গদ্যকবিতা লিখা হয়, এ বিষয়কে আপনি কিভাবে দেখছেন?
জিললুর: গদ্য কবিতা তো বহু আগে থেকেই লিখিত হচ্ছে। কবিতার কন্টেন্ট এর প্রয়োজনে যখন যে ফর্ম দাবি করে, তেমনটাই হওয়া বাঞ্ছনীয়। অনেকে ব্যাপারটা বোঝে না।
আর্থনিউজ২৪ : কবির ক্ষেত্রে কখন কবিতার বই করার উত্তম বলে মনে করেন?
জিললুর: কী জানি! এমন করে তো ভাবি নি। সন্তানের সংখ্যা নয়, যোগ্যতাই বেশি গুরুত্ব দাবি করে। প্রকাশনার সহজলভ্যতার সুযোগ না নিয়ে ভালো লেখার দিকেই আমাদের মনোযোগী হলে সর্বৈব মঙ্গল।
আর্থনিউজ২৪ : সাম্প্রতিক কবিতা সম্পর্কে কিছু বলুন।
জিললুর: সে-ই একই কথা। কোন অর্থে সাম্প্রতিক? কবিতা তো হাঁটতে হাঁটতে এতোদূর এগিয়েছে, কিন্তু এখনও যেন মনে হয়, চর্যাপদের যে ব্যঞ্জনা , তার মতো আর হয় না। রবীন্দ্রনাথের সেই রোমান্টিকতা, বা জীবনানন্দীয় প্রাকৃতিক অথচ পরাবাস্তবতা, শামসুর রাহমানের সমকালীনতা, আল মাহমুদের সোনালী কাবিনময় প্রেম ও বিপ্লব, এমন অনেক অনেক অর্জন তো আমাদের আছে।
আর্থনিউজ২৪ : কবিতায় যে উত্তর-আধুনিক ফর্ম, এই বিষয়কে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
জিললুর: আমার বুদ্ধিতে যা আসে, উত্তর আধুনিক কোনো ফর্ম এর ব্যাপার নয়। এটা এক ধরনের দার্শনিক অভিজ্ঞান বা চেতনার বিকাশ। আমাদের মধ্যে যারা এমন দর্শন বা চেতনার সাথে সম্পৃক্ত, তাদের লেখায় তার প্রকাশ ঘটেছে। হ্যাঁ, তাদের এই চেতনার প্রতিফলন যখন কবিতায় আসে, ভাষা ও ফর্মেও কিছু পরিবর্তনের চিহ্ন দেখা যায়। তবে যে অর্থে এই চেতনার বিকাশ ঘটার সুযোগ ও সম্ভাবনা ছিলো, কবিতা কি তেমনটা জোরালো প্রকাশ ঘটাতে পেরেছে?
আর্থনিউজ২৪ : ভবিষ্যতে কবিতার ট্রেন্ড কোন দিকে যেতে পারে বলে মনে করেন?
জিললুর: কবিতা মানুষের হৃদেয়র খোরাক। হৃদয়ের দিকেই তার অগ্রযাত্রা। টেকনোলজির বিকাশ, মনোজগতের টানাপোডেন, সমাজ-রাজনীতি-দর্শন এসবের সংশ্লেষ নিয়ে কবিতা মানুষের জীবনকে ওঁকে যাবে, জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
আর্থনিউজ২৪ : বর্তমান সময়ে কার কার কবিতা আপনার ভালো লাগে?
জিললুর: এখনও তো আমি রবার্ট ফ্রস্ট এর ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারি নি। লালনও তো খুব সমকালীন মনে হয়। জীবনানন্দের পাঠ প্রতিদিন নতুন নতুন অধ্যায়ের মতো উন্মোচিত হচ্ছে। আমার বন্ধুদের কিছু কবিতাতো প্রায়ই উল্টে পাল্টে পড়ি। কবিতায় যাদের নাম নতুন নতুন যোগ হচ্ছে, লিটল ম্যাগাজিনের বা ফেসবুকের কল্যাণে, সেখানেও আমার অনেক অনেক ভালো লাগা।