সুজন বড়ুয়া সাইম পেশায় চিকিৎসক।বর্তমানে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত আছেন। লেখালেখির সাথে যুক্ত হয়েছেন গত শতকের নব্বই দশকের শুরুতে। তাঁর হাতে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিন “চম্পকনগর” সম্পাদিত হয়েছে। কবিতার পাশাপাশি কবিতা-বিষয়ক প্রবন্ধ সাহিত্যে সক্রিয় আছেন। প্রচার বিমুখ এই কবির দুটি অনুবাদ গ্রন্থও রয়েছে। অনুবাদ গ্রন্থ দুটি হল- নোবেল বিজয়ী লেখক ভিএস নাইপলের “ওয়ান আউট অব মেনি ও ট্রাভেল জার্নাল” এবং নোবেল বিজয়ী চৈনিক লেখক গাও সিংজিয়ানের “দি আদার শোর”। কবিতা বিষয়ক কিছু প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আর্থ নিউজ ২৪-এর সাথে কথা বলেছেন- সুজন বড়ুয়া সাইম।

আর্থনিউজঃ কেন কবিতা লেখেন?
সুজনঃ এটাতো একান্ত ভালো লাগার বিষয়। তবে হ্যাঁ, এরকম ভালো লাগার কারণতো আছে নিশ্চয়। আমার আনন্দময় মুহূর্তকে কুসুম-উষ্ণতায় পরশ দেয় কবিতা। দুঃখকে জানিয়ে দেয় বেঁচে থাকার সরলশক্তি। প্রথমদিকে পূর্বানুমানহীন আনন্দময় অনুভূতির জন্য লিখতাম। পরবর্তীতে সেটা আবশ্যকতা প্রযুক্ত তাড়নায় পরিণত হয়। এই ‘তাড়নাকে’ বলতে পারেন আসক্তি বা নির্ভরশীলতা-ইম্পালসিভ এক্ট টার্ন ইনটু কম্পালশান। আসক্তি বলুন বা নির্ভরশীলতা বলুন, সেটা আরো গভীরভাবে অনুভব করি এই দীর্ঘ প্রবাস জীবনে। নক্ষত্রঘেরা শূন্যতার খাঁড়ি যখন জোনাকির আলোয় ভরে ওঠে তখন রাতের বিবর্ধিত সৌন্দর্যকে কবিতায় যেভাবে ধরা যায় সাহিত্যের অন্য মাধ্যমে ততোটা নয়। কবিতা আমার জগত-সংসারের ভাবনাকে, বিষয়ের পরিধিকে ব্যাপকতর করে। বস্তুগত পরিপার্শ্বের সাথে নিজের অস্থিত্ব ও আত্নপরিচয়কে বুঝে নেয়ার সহায়ক মাধ্যম হয়ে ওঠে কবিতা ।অসম্ভবের উপত্যকায় সূর্য-ছায়াকে ছোঁয়া যায় না তবে অনুভব করি কবিতার মায়াবী শরীরে। ঠিক তখনই মনে হয় কবিতা ও বিজ্ঞান নিকট প্রতিবেশী।
আর্থনিউজঃ কবিতা কী সবার জন্য, যদি সবার জন্য না হয়, তাহলে সবার জন্য নয় কেন?
সুজনঃ কবিতা যখন ছাপানোর জন্য পত্রিকায়, লিটল ম্যাগাজিন বা গ্রন্থ আকারে প্রকাশ করা হয় তখন কবিতা সবার জন্য লেখা হয়েছে বলে ধরা যায়। সবাই কবিতা পড়েন না। অনেকের পছন্দের তালিকায় কবিতা কখনো ছিল না। কবিতা শিল্প-সাহিত্যের অন্যতম জটিল মাধ্যমের একটি। তাই পাঠক অনেক সময় অস্থির হয়ে পড়েন কবির কাছে নিশ্চিত সমাধানের জন্য। কিন্তু কবিতাতো সম্ভাবনাকে উসকে দেয় আর পাঠক খুঁজবে সমাধান। সে-মত বিবেচনায় পাঠকের চিত্তে কবিতা অন্তরঙ্গভাবে মিলে নাও যেতে পারে। কবি চাইলেও সব কবিতা সবার জন্য হয়ে ওঠেনা।
আর্থনিউজঃ সাম্প্রতিক কবিতার যে দুর্বোধ্যতা এই বিষয়কে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
সুজনঃ প্রকৃতপক্ষে কোন কালেই দুর্বোধ্যতার অভিযোগ থেকে কবিতা মুক্ত ছিল বলে মনে হয় না। কোন বিষয়-ভাবনাকে শব্দের বিন্যাসে ছন্দ-ধ্বনি সৃষ্টি করে বহুমাত্রিক অর্থ ছড়িয়ে দ্যোতনা-ব্যাঞ্জনা-প্ররোচনায় যে কবিতাটি লেখা হয় তাতে একটা আড়াল তৈরি হয়। এটি কবিতার স্বকীয় চরিত্রও বটে। এর স্বরূপ উন্মোচনে যথেষ্ট মোটিভেশন, বিনামূল্যে শ্রমজাত পাঠ-প্রস্তুতি, সর্বোপরি সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতার দরকার হয়। আর এসবের ঘাটতি থাকলে যেকোন ভালো ও ‘যোগ্য কবিতা’ পাঠকের কাছে দুর্বোধ্য ঠেকতে পারে। আবার, ভালো ও ‘যোগ্য কবিতা’ লেখার দায়িত্ব কিন্তু কবির। অর্থাৎ ভালো কবিতা ও পাঠকের পাঠ-প্রস্তুতিমূলক সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে কবিতা চঞ্চল-চপল-কল্পনা জাগানিয়া না হয়ে যায়না।যদি কবিতাকে রুপকথা, রোম্যান্টিক ভাবালুতা ও হালকা বিনোদনের আধার হিসেবে মনে করা হয় তাহলে “কবির উদ্দেশ্য তার চারপাশের অবিচ্ছিন্ন জীবনের সঙ্গে প্রবহমান জীবনের সমীকরণে” দুর্বোধ্য মনে হবে।
আর্থনিউজঃ সাম্প্রতিক তরুণ কবি অগ্রজ কবিদের মধ্যে কি রকম কবিতা-পার্থক্য লক্ষ্য করেন?
সুজনঃ অপেক্ষাকৃত বেশি সময় ধরে কবিতা চর্চা, পাঠ-প্রস্তুতি ও অভিজ্ঞতার জন্য ‘অগ্রজ’ কবিরা কিছু সময়ের জন্য এগিয়ে থাকলেও একটু সময় গড়ালে যোগ্য ‘তরুণ’ কবিরা সে পার্থক্য গুছিয়ে নেন। অগ্রজ কবি হলেই ভালো কবিতা লেখা হবে তাতো নয়। যে কোন মানুষের মতন একজন কবিও কালগত, স্থানিক ও একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মাঝে বেড়ে উঠেন। সে-সবকে সনাক্ত করে চারপাশের চেনাজানা বিষয়-বস্তুর প্রতিচ্ছবি অনন্য শব্দরুচি ও সঠিক শব্দ-বিন্যাসে যদি কবিতায় ওঠে আসে তবে সেই কবিতার সৌন্দর্য আহরণে ‘তরুণ’ বনাম ‘অগ্রজ’-এর বিষয়টা মুখ্য মনে হয়না। তাছাড়া ‘সাম্প্রতিক’ শব্দটা স্বচ্ছ কাল-সীমা নির্দেশ করেনা, অনেক ক্ষেত্রে আপেক্ষিক। বিগত তিরিশ বছরের কবিতাকে ‘সাম্প্রতিক’ বলে ধরে নিতে পারি। বিশ শতকের আশি দশকের শেষে ও নব্বই দশকের শুরুতে দেশ-কাল-ঐতিহ্য-মিথ-লোকবিশ্বাস নিয়ে বাংলাকবিতা এগিয়ে যেতে-যেতে এখন নতুন ভাষা-রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। আবার উল্লিখিত সময়কালে বিপত্তিও বাধে। কারণ রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতা, রবীন্দ্রপূর্ব ও রবীন্দ্রোত্তর সময়ের অনেকের কবিতা সাম্প্রতিক নানা কারণে।
আর্থনিউজঃ বর্তমানে যে গদ্য কবিতা লেখা হয়, এ বিষয়েকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
সুজনঃ গদ্য কবিতাতো নতুন কোন ভঙ্গি নয়।গদ্য কবিতার প্রতি রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ সুবিদিত। ‘প্রথাচ্ছন্দরহিত’ গদ্য কবিতার পক্ষে রবীন্দ্রনাথের যুক্তি ছিল “ভাবগত ছন্দ”। গদ্য কবিতার সমর্থনে তিনি বলেন “সে নাচে না, সে চলে”। গদ্য কবিতার প্রতিআগ্রহের জন্য মোহিতলাল মজুমদারের নানা কটাক্ষ হজম করতে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে। যদিও রবীন্দ্রনাথ গদ্য কবিতার করণ-কৌশল শুরু করেছিলেন এবং গদ্য কবিতালিখেছেনও। তবে সার্থক গদ্য কবিতা রচনা করেন বিশ শতকের চল্লিশ দশকের কবি সমর সেন। এ-ছাড়াও বিশশতকের চল্লিশ দশকের কবি আবুল হোসেন ও সৈয়দ আলী আহসান উল্লেখযোগ্য গদ্য কবিতা রচনা করেছেন। ষাটের দশকের কবি সিকদার আমিনুল হকের কাব্যগ্রন্থ “সতত ডানার মানুষ” গদ্য কবিতা হিসেবে উভয় বঙ্গের কাব্য তাত্ত্বিক ও কবিদের ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছে। কবি নির্মলেন্দু গুন-এর সুবিখ্যাত কবিতা ‘হুলিয়া’ অনন্য গদ্য কবিতার উদাহরণ। যাই হোক কবিতার বিষয়-বস্তু বিবেচনা করে কবিতার গঠনরূপ তৈরি করতে পারলে গতিময়তা পায়। তবে যে-ভঙ্গিতে কবিতা লেখা হোক না কেন ‘ছন্দোময়তা’কে অস্বীকার করা যায় না পুরোপুরি। কবিতার কৌলীন্য পেতে হলে ধ্বনিময় জলসায় ধ্বনির রূপে মুগ্ধ হওয়া চাই। ‘কবিত্ব’ আর ‘কবিতা’ এক নয়।
আর্থনিউজঃ কবির ক্ষেত্রে কখন কবিতার বই করা উত্তম মনে করেন?
সুজনঃ কবি যখন নিজেকে প্রস্তুত মনে করবেন তখন কবিতার বই প্রকাশ করা যায়। এই “প্রস্তুতির সময়সীমা” বড়ো বেশি সাবজেক্টিভ। এটি কবির একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি, অভিরুচির উপর নির্ভর করে। কবিতার বই প্রকাশ না-করলে অশুদ্ধ কিছু হয় না। তবে প্রকাশে লাভের দিকটা বেশি। নিজের অবস্থান পাঠকের কাছে পৌঁছে দেয়া যায়। ভালো লেখা হলে সংগ্রহে রাখা যায়। তবে বই প্রকাশের পূর্বে পাঠ-প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ট সময় নেয়া দরকার। বেশি পরিমানে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের চেয়ে পরিমিত বোধের ভিতর দিয়ে ভঙ্গি ও ভাষায় স্বতন্ত্র কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হলে পাঠকের চিত্তে স্থায়ী আসন পায় এবং কালের বিচারে ঠিকে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
আর্থনিউজঃ সাম্প্রতিক কবিতা সম্পর্কে কিছু বলুন।
সুজনঃ ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি ‘সাম্প্রতিক’ স্বচ্ছ কাল-সীমা নির্দেশ করেনা। তাছাড়া কাব্য-শিল্পের প্রবণতা-পরিবর্তনের পূর্ণতা পেতে ও দৃষ্টিগ্রাহ্য হতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়।এও উল্লেখ করেছি যে, বিগত শতকের আশি দশকের শেষে ও নব্বই দশকের শুরুতে বাংলাদেশের কবিতা বাঁক নিয়ে ধারাবাহিকতায় নতুন ভাষার অবয়ব পেয়েছে। সমৃদ্ধ হচ্ছে। এটি চলমান প্রক্রিয়া। তবে কবিতা বৃহত্তর ক্যানভাসে চিন্তাকে উন্মুক্ত করতে চায়। মনুষ্যত্তের প্রতি পাঠকের মনোনিবেশ ঘটায়। চারপাশ যখন পূর্ণ হয় নষ্টদের জঞ্জালে তখন কবিতার শিল্পমান বজায় রেখে সামাজিক দায় নিতে পারছে কিনা সময় গড়ালে স্পষ্টতর হবে।
আর্থনিউজঃ কবিতায় যে উত্তর-আধুনিক ফর্ম, এই বিষয়কে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
সুজনঃ মূলত বিশ শতকের নব্বই দশকের শুরুতে ‘উত্তর আধুনিক’ কাব্য-আদর্শের চর্চা শুরু হয়েছিল। তবে এর ধরাবাঁধা, সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা ছিল বলে মনে পড়ছে না। ঘরে ফেরার তাগিদ ছিল। সে-সেময় চট্টগ্রাম থেকে কবি এজাজ ইউসুফী সম্পাদিত লিটল ম্যাগ ‘লিরিক’ উত্তর আধুনিক সংখ্যা বের হয়। উত্তর আধুনিক কবিতার প্রবণতা নিয়ে প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা হতে থাকে সাহিত্য-মহলে। দেশ-কাল-ঐতিহ্যকে বিবেচনায় নিয়ে আবহমান বাঙালি সমাজের মানবিক বোধ-সম্প্রীতির ভাষার প্রতি তৎকালীন তরুণ কবিদের প্রবল আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। অনেক তর্ক-বিতর্ক, গ্রহন-বর্জন শেষে উত্তর আধুনিক কাব্য-চেতনা বাংলা কবিতার সমৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক প্রভাব রেখেছে বলে মনে হয়।
আর্থনিউজঃ ভবিষ্যতে কবিতার ট্রেন্ড কোন দিকে যেতে পারে বলে মনে করেন?
সুজনঃ এই বিশ্বায়নকালে বহুজাতিক পুঁজির সাথে দেশীয় সংস্কৃতির সংঘাত বাড়ছে বৈ কমছেনা। স্যাটেলাইট সংস্কৃতি, ইন্টারনেট ও কর্পোরেট সংস্কৃতির দাপটে কবিতার ন্যায্য ভূমি রক্ষায় সংশয় থেকেই যায়। তবে এই সংশয়ের মধ্যেও কবিতা বাঁক নেবে আপন স্বভাবে এবং ঘরে ফেরার প্রবাহমানতা অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা যায়।
আর্থনিউজঃ বর্তমানে সময়ে কার কার কবিতা আপনার ভালো লাগে?
সুজনঃ বুদ্ধি আর অভিজ্ঞতার প্রশ্রয়ে দেশ-কালের কাঠামোতে ঐতিহ্য-মিথ-লোকবিশ্বাস ইত্যাদির সময়োপযোগী সমন্বয়ে যাদের কবিতা পরিচিত ভাষায় কথা বলে তাঁদের কবিতা বারবার পড়ি।