লিটন দাশ গুপ্ত
দুইটি সমাজে মতপার্থক্য থাকাতে ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকে। এমনই উত্তর পাড়ার মেয়ে কলি এবং দক্ষিণ পাড়ার ছেলে কমল। অফিস সহকারী কামালউদ্দীনের ছেলে কমল, শহরের স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হল। গ্রামের স্কুল শিক্ষক কাউছার মাষ্টার,তাঁর মেয়ে কলিকে নিজ স্কুলেই ভর্তি করিয়ে দিল।
সমবয়সী কমল-কলি ৮মশ্রেণী পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বী সমাজের প্রতিকূলতার মধ্যে একই সাথে খেলাধুলা,ঝগড়াঝাটি ও দুষ্টুমিতে বড় হয়। কিন্তু নভেম্বরে জে.এস.সি পরীক্ষার পর কমল শহরে চলে যায়।বিদায় বেলায় কিশোরী কলিকে কমল বলেছিল,‘চলেতো যাচ্ছি তোমার সাথে ঝগড়া করবে কে?’
শুনে কলি কান্না করে ফেলেছিল। তখন কমল বলেছিল, – ‘কান্না করনা,মোবাইল কিনে প্রথমেই তোমার সাথে কথা বলব।’
কয়েকদিন পর কলির মা, ‘কিরে কলি নবম শ্রেণীতে উঠার পর, খাওয়া নেই নাওয়া নেই, সারাদিন শুধু গান, এমন হোলি কেন?’
কলি, ‘আমার কেমন জানি এলোমেলো মনে হচ্ছে,কিছুই ভালো লাগছেনা’।
‘স্কুলে ক্লাস ঠিক মত হচ্ছে?’
‘বাবাকে জিজ্ঞাস করলে তো হয়, বাবাতো টিচার।’
‘এভাবে বলিস কেন রে!’…….
এরই মধ্যে স্কুলে নার্গিস, সুরভী, রাশি’র সাথে কলি’র বেশ বন্ধুত্ব হয়েছে।
অন্যদিকে, শহরের বিদ্যালয়ে বন্ধুদের সাথে নিজ গ্রাম ও বন্ধুবান্ধবীদের সম্পর্কে আড্ডা দিতে থাকে। বন্ধুদের মধ্যে বিজয়,ইকবাল,পল্লব খুবই ঘনিষ্ট হয়ে গেছে। একদিন আলাপ কালে কমল বলল,‘আচ্ছা বল্তো ইকবাল, কাউকে যদি ভালো লাগে তা কিভাবে উপস্থাপন করতে হয়?’
ইকবাল বলল, ‘প্রেম নিবেদন! এত তাড়াতাড়ি কাকে ভালো লাগলো আবার?’
পল্লব বলল, ‘সাহস নিয়ে কাছে যাওয়া সহজ কথা নয়।’
ইকবাল, ‘গোলাপ হাতে নিয়ে, কাছে গিয়ে চোখ বন্ধ করে বলে দে – I love you.’
কমলের সরলতা নিয়ে বন্ধুরা ইতোমধ্যে দুষ্টুমি শুরু করেদিয়েছে।
সেদিন খাবার টেবিলে কলির মা কথার প্রসঙ্গে বলছে,‘বংশ মর্যাদাহীন সমাজবিচ্ছিন্ন কামালউদ্দীনের ছেলেকে শহরে নিয়ে পড়াচ্ছে’।
কলির বাবা,‘তাদের টাকা আছে পড়াচ্ছে তাতে কি?’
‘জজ ব্যারিষ্টার বানাবে ছেলেকে।’
কলি,‘দক্ষিণ পাড়ার সাথে আমাদের সব সময় ঝগড়া থাকে কেন মা?’…..
এক রাতে পড়ার টেবিলে কমল তার বাবাকে বলছিল,‘জানুয়ারী মাসতো চলেই গেল, মোবাইল এখনো কিনে দিলেনা।’
‘কালকে একটা কিনে নিস।
‘তুমি কিনে আনতে পারবেনা?’
‘অফিস শেষে একসাথে যাব, পছন্দ করে কিনবি’…..।
এইদিকে ঘরে থাকা মোবাইলে call/sms আসলে খুশী হয়ে কলি দৌড়ে দেখতে যাই,কিন্তু না কমলের নয়।
রাতে শুয়ে শুয়ে কলি মোবাইলে মান্নাদে’র গান শুনছে, “তুমি কি সে আগের মত আছ নাকি অনেক খানি বদলে গেছ …….।
হঠাৎ unknown number থেকে sms এল, যেখানে “৯ — ১২.১৫.২২.৫ – – ২৫.১৫.২১’’ সংখ্যাগুলো এইভাবে সাজানো ছিল।দেখে ‘ধ্যেৎ’ বলে মোবাইল ফেলে রাখল।
কমল রাতে পড়তে বসে নতুন মোবাইলের ফাংশনগুলো দেখছে। একটুপরে বাবাকে বলল,‘বাড়ি থেকে আসছি নভেম্বরে,যাব কখন বাবা?’
‘১২ফেব্রুয়ারী বাড়ি যাবি, রবিবারে আমার সাথে চলে আসবি’।…….
কলি স্কুলে গিয়ে তার বান্ধবীকে বলল,‘সুরভী একটি unknown number থেকে শুধুই মিসকল পাচ্ছি।’
সুরভী, ‘তুইও মিসকল দিয়ে দেখ্,হয়ত মিসেস কল হয়ে যাবে’।
রাশি বলল, ‘আচ্ছা তোর যে একটা বন্ধু ছিল বলেছিলি তার খবর কি?’
সুরভী, ‘শহরে নানা রঙের চেনা অচেনা পাখি আছেনা!’
নার্গিস,‘ঠিকই বলেছিস, সে তো কবেই ভুলে গেছে।’…..
কলি প্রতি রাতের মতো গান শুনে শুনে ঘুমানোর চেষ্টা করছে, হঠাৎ দেখল সেই unknown number থেকে call, কলি রিসিভ করে, ‘হ্যালো,হ্যালো কে বলছেন প্লীজ?’
ডায়েল প্রান্ত থেকে ‘আপনি কে বলছেন প্লীজ?’
‘wrong number’ ’ বলে কেটে দিলে আবারও কল…….
এবার একটু রেগে কলল, ‘কে বলছেন আপনি’?
‘আমি বলছি‘।
‘আমি কে’?
‘আপনার নামের প্রথম অক্ষর আমার নামের প্রথম অক্ষর একই।’
‘আরে কমল! তুমি এতদিন পর, কিঅবস্থা, কেমন আছ বল?’
‘আগে বল তুমি কেমন আছ?’
‘এতদিন পর আমাকে মনে পড়ল বুঝি?’
‘মনে পড়েছে প্রত্যেকদিন, এতদিন পর কেন রিং দিলাম সেটা জিজ্ঞাস কর?’
‘জিজ্ঞাস করলে তো বলবে, মোবাইল কেনা হয়নি এতদিন।’
‘ওরে বাপরে, খুবই তো স্মার্ট হয়ে গেলে দেখছি।’
বেশ কিছু কথাবার্তা বলার পর…..
কলি,‘তোমার sms-এ, হ-য-ব-র-ল সংখ্যাগুলোর মানে কি?’
‘এটি জীবনের প্রথম এবং শেষ সিদ্ধান্ত, বুঝে নিও।’
‘বলনা প্লীজ! আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে।’
‘বললাম তো, এটি আমার জীবনের মহৎ এবং বৃহৎ সিদ্ধান্ত।’
‘আমি কি শুনতে পারিনা?’
‘এটি শুনার নয় বুঝার বিষয়।’
‘তাহলে বুঝিয়ে দাও।’
‘বুঝানো যায় না, অনুভব করে বুঝে নিতে হয়।’
কলি স্কুলে বান্ধবীদের কাছে কমলের বিষয়টি উপস্থাপন করল। কমলের সাথে কথোপকথনের বিষয়ে সবাই খুশী হয়ে মিষ্টি,ফুসকা খাওয়াতে বলে।
কলি, ‘খাওয়াবো তবে- sms এ দেয়া সংখ্যাগুলোর মানে বের কর আগে।’
কাউছার ঘরে মেয়ে কলিকে পড়াতে বসল। কলির মা টেবিলে চা এনে বলল,
science তো দিয়েছো ভালোভাবে দেখো।’
কাউছার, ‘এ+ তো পেতেই হবে।’
কলি, ‘বাবা, এই সংখ্যা গুলোতে কি বুঝায়?’
‘একক,দশক,শতক,হাজার…..’
‘সংখ্যাটি পড়তে বলেনি, তাৎপর্য বুঝাতে বলেছি।’
‘সংখ্যার আবার তাৎপর্য কি,নাস্তা খেয়ে নে।’……
রাতে শুয়ে কলি লতা’র গান শুনছে,“আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাব হারিয়ে যাব আমি তোমার সাথে…..
কমলের রিং, মোবাইলে কুশলাদি বিনিময়ের পর কলি,‘কখন আসবে?’
‘আমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে?’
‘খুব বেশী’
‘তাহলে ১২তারিখ আসবো।’
‘আগামী বৃহস্পতিবারে?’
‘হ্যাঁ,আর ৩দিন অপেক্ষা কর।’
‘সত্যি বলছ!’
‘মিথ্যা বলছিনা।’…..
কথা তাদের শেষ হয়না,তবুও শেষ করতে হয়।
এই দিকে কলি আনন্দে আত্মহারা হয়ে স্কুলের বান্ধবীদের অবহিত করেছে। নার্গিস বলল, ‘আমাদের সাথে পরিচয় করে দিবিনা?’
রাশি, ‘দেখতে কেমনরে, একেবারে রাজপুত্তুর নাকি?’
কলি, ‘না-না, আমাদের ক্লাসের সেলিমের মত চকলেট কালার।’
সুরভী, ‘ভ্যালেন্টাইনডে শুভ দিন, ইনিংস শুরু কর।’
নার্গিস, ‘ঠিকই বলেছিস, ওতো ঠিক সময়েই আসছে।’
এইদিকে ভাত খাওয়ার সময় কথার প্রসঙ্গে কমলকে তার বাবা জানাল, ‘সমাজের অবস্থা ভালো নয়।’
কমল বলল, ‘আবারো ঝগড়া বাঁধলো?’
‘শুনেছি কাউছার মাষ্টার আমাকে সহ সাত জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দিয়েছে।’
‘সমাজে হামলা মামলা গুলো কি শেষ হবেনা?’
কমলকে নিয়ে সবার সাথে ভ্যালেন্টাইনডে পালন করবে,সেই প্রত্যাশায় আছে কলি। কমল আসার প্রহর গুনছে, দেখতে দেখতে ৩ দিন শেষ, কিন্তু আসার দিন, অর্থাৎ ১২ তারিখ, কমল সকালে কলিকে বলে দিয়েছে, সে আসতে পারবে না, কারণ তার বাবা বলে দিয়েছে, পরের বৃহস্পতিবারে যেতে।
শুনে কলির মন খুবই খারাপ হয়ে গেল, কি করবে উপায় নেই, স্কুলে যাচ্ছে,গান শুনছে, আবারও নতুন ভাবে আসার প্রহর গুনছে, স্বপ্ন দেখছে।
১৪তারিখ সকালে কমল ভ্যালেন্টাইনের শুভেচ্ছা জানিয়ে, আসতে না পারার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করল। এমন বিশেষ দিনে দেখা করতে না পারার জন্যে নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করছে কমল।
সেই দিন, ঘণ্টা খানেক পরে কমল সেই sms টি আবার send করল কলির কাছে।
১৪ফেব্রুয়ারীতে পার্ক,স্কুল,কলেজ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেন ভালোবাসায় ভাসছে। তরুন ও যুব সমাজে সাজ সাজ রব। কলি স্কুলে বান্ধবীদের সাথে মাঠের দক্ষিণ পাশে তেতুল গাছের নীচে বসে গল্প করছে। হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন এসে কলির চোখ দুটো হাত দিয়ে চেপে ধরল। কলি, ‘কে? কে বলছি ছাড়ো।’ এইবলে হাত ছাড়ার চেষ্টা করছে।
এইদিকে হঠাৎ কোথায় থেকে কোন ছেলে একটা এই ভাবে দুষ্টুমী করছে বান্ধবীরা দেখে অবাক! পরে হাত ছাড়লে খুশী হয়ে কলি,‘এই ভাবে surprise দিলে!’…….
এরপর কিছুক্ষণ আনন্দের বন্যা বয়ে গেল।
সবার সাথে কমলকে পরিচয় করিয়ে দিল,সবাই sms টির ব্যাখ্যা জানতে চাইলে কমল বলল, ‘Aহতে Z পযর্ন্ত বর্ণগুলোর নীচে যথাক্রমে ১ থেকে ২৬ পযর্ন্ত সংখ্যা লিখে, পাঠানো sms মিলিয়ে দেখো।’ বলেই পিছন দিকে হাঁটতে থাকে।
সবাই কৌতুহল হয়ে দেখে সেই sms টি হচ্ছে I-LOVE-YOU.
কমল হাঁটছে, হাত দেখাচ্ছে, আর কিশোর কুমারের গানটি গেয়ে যাচ্ছে, “পৃথিবী বদলে গেছে যা দেখি নতুন লাগে, তুমি আমি একই আছি দুজনে যা ছিলাম আগে……
আগামীকাল ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে আরও ভালোবাসার গল্প চলমান থাকবে…।