[english_date]

এসো হে বৈশাখ-আনিসুজ্জামান

আমার ছেলেবেলায়- গত শতকের চলি্লশের দশকে- ইংরেজি নববর্ষ পালনেরই ঘটা ছিল। ইংরেজ এবং ইঙ্গ-ভারতীয় পরিবারে নিউ ইয়ারস্ ইভে শুরু হতো আনন্দোৎসব, তার জের চলত পয়লা জানুয়ারিতে। তার দেখাদেখি সচ্ছল বাঙালি পরিবারেও পালিত হতো নিউ ইয়ার- তার কলধ্বনি পেঁৗছে যেত প্রতিবেশীদের এবং পথচারীদের কর্ণকুহরে।

বাংলা নববর্ষ মানে তখন ছিল হালখাতা। আব্বা ছিলেন হোমিওপ্যাথ। কলকাতার তিনটি প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি ওষুধ কিনতেন :এলিয়ট রোডের কিং অ্যান্ড কোম্পানি, বউবাজারের এম ভট্টাচার্য অ্যান্ড কোম্পানি এবং ডালহাউসি স্কয়ারের সি রিঙ্গার অ্যান্ড কোম্পানি। হালখাতার নেমন্তন্ন আসত তাদের কাছ থেকে প্রতিবছরে। তিনটেতে না পারলেও অন্তত দুটি জায়গায় আব্বা নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যেতেন আমাকে সঙ্গে নিয়ে। হালখাতা বলতে আমার কাছে ছিল মিষ্টিমুখ করা এবং মিষ্টির বাক্স সঙ্গে নিয়ে ফেরা।

গানবাজনার মধ্য দিয়ে নববর্ষ আবাহন করতে দেখলাম ঢাকায় এসে। লেখক-শিল্পী মজলিস নামে একটি স্বল্পস্থায়ী সংগঠন ১৯৪৯ ও ১৯৫০ সালে মাহবুব আলি ইনস্টিটিউটে আয়োজনটা করেছিলেন। কবিতাপাঠ- রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের এবং উপস্থিত কবিদের স্বরচিত- আর কণ্ঠসংগীত ছিল তার সূচিতে। সংগঠনটির কর্ণধার ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক অমিয় (ভূষণ) চক্রবর্তী। ১৯৫০-এর দাঙ্গার পরে তিনি দেশত্যাগ করেছিলেন, ওই সংগঠনের কর্মসূচিও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

১৯৫১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ। সওগাত প্রেসের একটা বড়ো ঘরে শতরঞ্চি বিছিয়ে আমাদের পাক্ষিক সাহিত্যসভা বসত। সেখানেই আমরা অনিয়মিতভাবে নববর্ষ পালন করেছি- মূলত প্রবন্ধ ও কবিতা পড়ে, কখনো কখনো গানের আয়োজন করে। তা ছাড়া অগ্রণী শিল্পী সংঘ মূলত সংগীত দিয়ে নববর্ষ আবাহন করত। এদিক-সেদিকে থাকত আরও ছোটখাটো আয়োজন।

পাকিস্তান সরকার যে বাংলা নববর্ষ-পালন ভালো চোখে দেখছে না, সেটা যেন কীভাবে টের পাওয়া যেত। আমাদের শিক্ষক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী নববর্ষ উপলক্ষে একটি প্রবন্ধ পড়েছিলেন পাকিস্তান সাহিত্য সংসদে, সেটা পরে ছাপা হয়েছিল দৈনিক সংবাদে। তাতে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, ইরানের মুসলমানেরা যদি প্রাক্-ইসলাম নওরোজের উৎসব করে যেতে পারে, তাহলে পূর্ব পাকিস্তানে আমরা কেন মোগল বাদশাহ্-প্রবর্তিত বাংলা সনের অভ্যর্থনা করতে পারব না? বলধা গার্ডেনে একবার নববর্ষ পালিত হয়েছিল গান গেয়ে আর খই-মুড়ি খেয়ে। সে সঙ্গে একটু চাপা উত্তেজনা ছিল।

তার পর ছায়ানটের পয়লা বৈশাখ উদযাপনের শুরু- প্রথমে মৃদুভাবে, তারপর সাড়ম্বরে। বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি সরকারি মনোভাব যে প্রতিকূল, লোকে এ-কথাটা যতই বুঝেছে, ততই প্রবল হয়েছে তার নববর্ষ, রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তী, বসন্ত-উৎসব প্রভৃতি পালনের স্পৃহা। ছায়ানটের নববর্ষ-উদ্যাপন তাই বছর থেকে বছরে বেশি মানুষকে আকর্ষণ করেছে, নববর্ষে ব্যক্তিরও সাজসজ্জা হয়ে উঠেছে লক্ষণীয়। তারপর সে-আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে।

পয়লা বৈশাখ আজ বাংলাদেশের সবচাইতে বড়ো উৎসবে পরিণত হয়েছে। এখন ছায়ানটের আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চারুকলা ইনস্টিটিউট বা অনুষদের মঙ্গল-শোভাযাত্রা, ঋষিজ গোষ্ঠীর অনুষ্ঠান। গত কয়েক বছর ধরে সুরের ধারা নববর্ষকে আবাহন করছে চৈত্রসংক্রান্তির সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত সহস্র শিল্পীর কণ্ঠে গান গেয়ে। পাশাপাশি বসছে বিসিকের বৈশাখী মেলা। বাংলা একাডেমিতে আয়োজিত হচ্ছে স্বরচিত কবিতাপাঠের আসর, গান, বক্তৃতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকেরা অনুষ্ঠান করছে। পুরো দেশ মেতে উঠছে ‘এসো হে বৈশাখ’ বলে।

নববর্ষ-উৎসবের সমালোচকেরা এখনো আছেন আমাদের মধ্যে। কেউ বলেন, পয়লা বৈশাখে সানকিতে করে পান্তাভাত ও ইলিশ মাছ খাওয়া দেশের সাধারণ মানুষকে ঠাট্টা করার মতো। তাঁরা ভুলে যান যে, উৎসবের দিনে মানুষ তা-ই করে, যা তার নিত্যনৈমিত্তিক নয়। কেউ বলেন, পয়লা বৈশাখে সূর্যাস্ত হলেই আমাদের আর বাংলা পঞ্জিকার হিসাব থাকে না। কথাটা সত্যি। বাংলা মাসের হিসাবে মাস-মাইনে না পাওয়া পর্যন্ত কিংবা সরকারি কাজেকর্মে বাংলা তারিখের ব্যাপকতর প্রচলন না হওয়া পর্যন্ত এমনই ঘটবে। কেউ প্রথাগত পঞ্জিকা আর বাংলাদেশে সরকারিভাবে সংস্কার করা বাংলা পঞ্জিকার অসামঞ্জস্য নিয়ে বিদ্রূপ অথবা দুশ্চিন্তা করেন, তাও হয়তো অকারণ নয়।

তারপরও নববর্ষের দিনটিতে আমরা যে প্রাণের আনন্দে মেতে উঠি, তা অকৃত্রিম। এই উৎসব সকলকে এই বার্তা দেয় যে, আমাদের একটি নিজস্ব সন আছে, পঞ্জিকা আছে। তা আমাদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের স্মারক। বাঙালির এই স্বকীয়তা আমরা ভুলতে দিতে চাই না। প্রাণমন দিয়ে তাই আমরা আবাহন করি বৈশাখের পয়লা দিনটিকে। পরস্পর বিনিময় করি শুভেচ্ছা। যথাসাধ্য সুন্দর হয়ে আত্মপ্রকাশ করতে চাই।

Share on facebook
Share on twitter
Share on whatsapp
Share on print

মন্তব্য করুন

সর্বশেষ সংবাদ