বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে গত তিন বছরে কঠিন শর্তে ১৫০ কোটি ডলারের বিদেশী ঋণ নিয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এ খাতের কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে আরো ৬০০-৭০০ কোটি ডলার ঋণ নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। সব মিলিয়ে কঠিন শর্তের ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৮০০ কোটি ডলারের (৬২ হাজার ৩২০ কোটি টাকা) বেশি। বিরাট অঙ্কের এ ঋণ পরিশোধে যে ধরনের ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন, পিডিবির অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর তা না থাকায় এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে অর্থ বিভাগ। সম্প্রতি অর্থ বিভাগের এক বৈঠকে এ নিয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করা হয়।
বৈঠকে বলা হয়, বৈদেশিক উৎস থেকে এ বিপুল পরিমাণ অনমনীয় ঋণ সঠিকভাবে পরিশোধে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা রয়েছে। এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে ঋণগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনাগত সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন। তা না হলে প্রতিষ্ঠানগুলো সময়মতো ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হবে। তখন এসব ঋণের দায় পড়বে সরকারের ওপর।
এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, কেবল ঋণ নিলেই হবে না। ঋণ পরিশোধও করতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান ঋণ নিচ্ছে, তা কীভাবে ব্যবহার করছে, পরিশোধইবা কীভাবে হবে, তা জানা প্রয়োজন।
জানা গেছে, ২০১২ সালে আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেডের ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ৩ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে এইচএসবিসি করপোরেট ট্রাস্টি ইউকেকে গ্যারান্টি দেয় সরকার। পরের বছর একই কোম্পানির ২২৫ মেগাওয়াট কেন্দ্রের ১ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশকে গ্যারান্টি দেয়া হয়। ২০১৩ সালে পিডিবি-আরপিসিএল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়নাকে ১ হাজার ১১২ কোটি টাকার ঋণের গ্যারান্টি দেয়া হয়। ২০১৪ সালে শাহজিবাজার ৩৩০ মেগাওয়াট কেন্দ্র নির্মাণে এইচএসবিসির ২ হাজার ৫৭ কোটি টাকার সিন্ডিকেট ঋণের বিপরীতে গ্যারান্টি দেয় সরকার। এছাড়া চলতি বছর বড়পুকুরিয়া ২৭৫ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্প্রসারণে ১ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা ও ঘোড়াশাল ৩৬৫ মেগাওয়াট কেন্দ্র নির্মাণে ১ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে চীনা প্রতিষ্ঠান আইসিবিসিকে গ্যারান্টি দেয়া হয়। আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ঋণেরও গ্যারান্টি দিয়েছে সরকার। বিদ্যুৎ খাতের কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে পাইপলাইনে আছে আরো ৬০০-৭০০ কোটি ডলার কঠিন শর্তের ঋণ, যা রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টির।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, গ্যারান্টি দেয়ার পর নয়, ঋণ নেয়ার আগে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে ভাবার প্রয়োজন ছিল। বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনাগত সক্ষমতা কেন নেই, সেটিও বিবেচনা করতে হবে। তাদের নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা না থাকলে দক্ষতা কীভাবে আসবে।
বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর ওপর মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণের কারণে তাদের নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই বলে মনে করেন তিনি। ড. জাহিদ হোসেন বলেন, কর্তৃত্ব না থাকার কারণে ব্যবস্থাপনাগত সক্ষমতা ও জবাবদিহিতাও নেই। এগুলো প্রতিষ্ঠা করতে হলে নীতিগত পরির্তন আনতে হবে।
অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়, রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি দেয়ার সময় অর্থ বিভাগ ঋণগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানকে ব্যবস্থাপনার দক্ষতা, হিসাব ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, হিসাব নিরীক্ষাসহ বেশকিছু শর্ত পূরণের কথা বলে। কোম্পানিগুলো এসব শর্ত পূরণের প্রতিশ্রুতি দিলেও পরবর্তীতে তা তারা পালন করে না। গ্যারান্টি নেয়ার পর বিষয়গুলো তারা আমলেই নেয় না। কোনো কোনো কোম্পানি অ্যাকাউন্টিং সফটওয়্যার ছাড়াই হিসাব পরিচালনা করছে। এ কারণে তাদের হিসাবের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো ভালো অবস্থানে আছে বলে জানান পিডিবির সদস্য (জেনারেশন) মিনহাজউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, সব বিদ্যুৎকেন্দ্রই ভালো অবস্থানে রয়েছে। যারা উৎপাদনে রয়েছে, সবাই মুনাফায় রয়েছে। তাই এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই।
অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়, গত সাত বছরে সরকারের গ্যারান্টি বেড়েছে ৮ হাজার ৩০০ শতাংশ। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের ঋণের বিপরীতে সরকারের গ্যারান্টি ছিল ৭২০ কোটি টাকা। ২০০৯-১০ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৪০ কোটি টাকা, ২০১০-১১ অর্থবছরে ৪ হাজার ৯৮০ কোটি ও ২০১১-১২ অর্থবছরে ২৯ হাজার ৪১০ কোটি টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা কমে আসে ৮ হাজার ৪৬০ কোটি টাকায়। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে গ্যারান্টি আবার বেড়ে দাঁড়ায় ৫৯ হাজার ১৭৫ কোটি টাকায়। আর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ছিল ৬৬ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা।
সরকারি গ্যারান্টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। তারা বলেছে, সরকারি নীতি বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ঋণ নিলেও এসব ঋণ সরকারকে অতিরিক্ত দেনায় ফেলছে। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে তার দায় সরকারকেই নিতে হবে।