ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় পুরুষ নারীর উপর প্রতিষ্ঠা করেছে তার আধিপত্য। কিন্তু সুযোগ পেলে পুরুষের মত নারীরাও পারে তাদের সাফল্যগাঁথা রচনা করতে। ইতিহাসেই রয়েছে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ৬৯৫ খ্রিষ্টাব্দে উত্তর আফ্রিকার জেনেতা বার্বার সম্প্রদায় কাহিনা নামের এক নারীর নামে সংঘবদ্ধ হয়ে হাসান ইবনে নামান এর অধীনস্থ বাহিনীকে পর্যদুস্থ করেছিল। এক্ষেত্রে ফ্রান্সের কিংবদন্তি নারী জোয়ান অব আর্কের কথাও স্মরণীয়। এ উপমহাদেশেও রয়েছে নারীদের বহু সাফল্যগাঁথা। সুলতানা রাজিয়ার নাম এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। বাবার মৃত্যুর পর ১২৩৬ সালে প্রবল আপত্তির মুখেও দিল্লীর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন রাজিয়া। বাংলায় কৃষক বিদ্রেহের কিংবদন্তি নায়িকা হয়ে আছেন রংপুরের দেবী চৌধুরাণী। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী নেত্রী ইলা মিত্রের সাহসিকতা আজো আমাদের অনুপ্রাণিত করে। সেই অতীতের যুদ্ধ বিগ্রহ থেকে আজকের মহাকাশ জয়- সবখানেই রয়েছে নারীর পদচিহ্ন। শুধু তাই নয় যোগ্যতাকে তুলে ধরার পাশাপাশি নারী চালিয়ে যাচ্ছে তার অধিকার অর্জনের দীর্ঘ সংগ্রাম। আঠারো শতকের শেষভাগে যখন পূরুষেরা দেশে দেশে বিপ্লব করে যাচ্ছে তেত্রিশ বছরের এক তরুণী তখন ঘোষণা করেন নারীমুক্তির ইশতেহার। মার্কিন এই তরুণীর নাম মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট। ১৭৯২ সালে বেরোয় তার ভিন্ডিকেশন অফ দি রাইটস অফ ওম্যান যাকে নারীবাদের প্রথম মহাইশতেহার মনে করা হয়। পিতৃতন্ত্র নানা প্রথা আর কুসংস্কারের জন্ম দিয়ে নারীর উপর চালিয়েছে অকথ্য অত্যাচার। এমনকি কখনও প্রভুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে কেড়ে নিয়েছে বেঁচে থাকার অধিকার। ভারতীয় উপমহাদেশের সহমরণ ও সতীদাহ প্রথা নারী নির্যাতনের এমনই দৃষ্টান্ত। এই কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন রামমোহন রায়। এর ধারাবাহিকতায় ১৮২৯ সালে লর্ড বেন্টিংক সতীদাহ নিষেধ বিধিতে স্বাক্ষর করেন। একইভাবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় ১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই ভারতে বিধবা বিবাহ আইন প্রবর্তিত হয়। আমেরিকানদেরও আছে নারী অধিকার আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাস। ১৮৩৭ এ আমেরিকায় প্রথম দাসপ্রথাবিরোধী নারীসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। দাসপ্রথা রহিতকরণ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই মার্কিন নারীরা রাজনীতিতে প্রবেশ করে। ১৮৩৮ সালে দুই মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ বোন গ্রিম্কে কৃতদাস ও নারী মুক্তিকে অভিন্ন করে দেখে সমস্যা সমাধানের দাবী জানান। নারীর ভোটাধিকার অর্জনে ১৮৪৮ সালের ১৯ ও ২০ জুলাই নিউইয়র্কের সেনেকা ফলস এ প্রথম নারী অধিকার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বহু সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯২০ সালের ২৬ আগস্ট মার্কিন কংগ্রেস নারী ভোটাধিকার সংশোধনী বিল পাস হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে যখন সোচ্চার হন রামমোহন রায় সেসময় সমাজতান্ত্রিক দার্শনিক উইলিয়াম টমসন ইউরোপে নারীদের জেগে ওঠার ডাক দেন। যুক্তরাজ্যে নারী ভোটাধিকার আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে ১৯১৩ সালে। এ বছরই নারী আন্দোলনে প্রথম শহীদ হন এমিলি ওয়াইল্ডিং ডেভিসন। এই পথ ধরেই ১৯১৮ সালে যুক্তরাজ্যে ত্রিশোর্ধ নারীরা ভোটাধিকার পান। ১৯২৮ এ তাদের ভোটাধিকারের বয়স কমিয়ে পুরুষের সমান ২১ বছর করা হয়। ভারতে ১৯২১ সালে মাদ্রাজের নারীরা প্রথম ভোটাধিকার লাভ করে। ১৯২৯ এর মধ্যে সব প্রদেশে এই অধিকার প্রতিষ্ঠা পায় । বাংলার নারীরা ভোটধিকার পায় ১৯২৫ সালে। ভারতে নারীদের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতাটি ছিল শিক্ষার অধিকার। ১৮৪৯ সালের মে মাসে জে.ই.ডি. বেথুন কলকাতায় স্থাপন করেন ভিক্টোরিয়া গার্লস স্কুল। ১৮৮৩ সালে ভারতীয় নারীদের মধ্যে প্রথম বি এ পাস করেন কাদম্বিনী বসু। ১৮৮৪ প্রথম এম এ পাস করেন চন্দ্রমুখী বসু। তবে এক্ষেত্রে স্বভাবতই পিছিয়ে ছিল মুসলমান নারীরা। বাঙ্গালি মুসলমান নারীদের মধ্যে প্রথম এম এ পাস করেন ফজিলাতুন্নেসা ১৯২৭ সালে। তবে বাংলায় নারী অধিকার
আর শিক্ষার কথা বললে যার নাম আপনা আপনি চলে আসে তিনি এদেশে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া। ১৯০৪ সালে প্রকাশিত হয় বেগম রোকেয়ার বিপ্লবী প্রবন্ধ ‘স্ত্রী জাতির অবনতি’। ১৯১১ এর ১৬ মার্চে রোকেয়ার উদ্যোগে কলকাতায় সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। নারী আজ প্রমাণ করেছে কোন কাজই তার কাছে অসাধ্য নয়। নারী তার কর্ম দিয়ে এমনকি জয় করে নিয়েছে বিশ্ববাসীর হৃদয়। মাদার তেরেসা আজ দেশ জাতির উর্দ্ধে সবার কাছেই শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার প্রতিমূর্তি। তবু অধিকার আর মর্যাদার জন্য নারীর যে দীর্ঘ সংগ্রাম তা আজো অসমাপ্ত। বিশ্বের নারী সরকারপ্রধান শ্রীমাভো বন্দরনায়েক
(শ্রীলঙ্কা, প্রধানমন্ত্রী, ১৯৬০),
ইন্দিরা গান্ধী (ভারত, প্রধানমন্ত্রী, ১৯৬৬), গোল্ড মেয়ার
(ইসরায়েল, প্রধানমন্ত্রী, ১৯৬৯), ইসাবেলা পেরন
(আর্জেন্টিনা, রাষ্ট্রপতি, ১৯৭৪), মার্গারেট থ্যাচার
(যুক্তরাজ্য, প্রধানমন্ত্রী, ১৯৭৯), কোরাজান
অ্যাকিনো (রাষ্ট্রপতি, ফিলিপাইনস, ১৯৮৬), বেনজির ভুট্টো (পাকিস্তান, প্রধানমন্ত্রী, ১৯৮৮),
খালেদা জিয়া (বাংলাদেশ, প্রধানমন্ত্রী, ১৯৯১), শেখ
হাসিনা (বাংলাদেশ, প্রধানমন্ত্রী, ১৯৯৬)।
* প্রথমবার দায়িত্ব গ্রহণের সাল উল্লেখিত।