
আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের অধিকাংশ প্রার্থী দলীয় মনোনয়ন পাওয়াকেই বিজয় মনে করছেন। তাই কার্যালয়ে নিজেদের চেনানোর জন্য নিজেদের সর্বস্ব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। অনেকে দল বদল করে আওয়ামী লীগের মনোনয়নের জন্য দৌড়ঝাঁপ করছেন, পেয়েছেনও কেউ কেউ।পৌর নির্বাচনে দলীয় মেয়র প্রার্থীদের বিজয় তাঁদের মধ্যে এমন মনোভাব তৈরি করেছে।দলের কেন্দ্রীয় নেতা, ইউপি নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পাওয়া ও বঞ্চিত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এই মনোভাব পাওয়া গেছে। মনোনয়নবঞ্চিত ব্যক্তিদের অনেকে ধানমন্ডি কার্যালয়ে এসে কেন্দ্রীয় নেতাদের পায়ে ধরে পর্যন্ত কান্নাকাটি করেছেন। তাঁরা বলেছেন, দলের মনোনয়ন পেলে জয় নিশ্চিত। আর মনোনয়ন পাওয়া ব্যক্তিরা বলেছেন, নির্বাচনে জয়ী হওয়ার মতোই কঠিন ছিল মনোনয়ন পাওয়া। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া অন্তত ২০ জনের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁদের সবাই বলেছেন, দলের মনোনয়ন পাওয়ার পর জয়টা খুব কাছে দেখছেন। তবে এরপরও ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাবেন, প্রচারে ঘাটতি রাখবেন না।
দলের একজন সদস্য মনে করেন ,মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীরা আত্মবিশ্বাসী হবেন এটাই স্বাভাবিক। দল-বদল করে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দু-একটা ক্ষেত্রে হতে পারে। তবে খুব বেশি হওয়ার কথা নয়। যাচাই-বাছাই করে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।’খুলনা জেলার একটি ইউনিয়নের মনোনয়ন পাওয়া চেয়ারম্যান প্রার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘দলের ছয়জন প্রার্থীকে টেক্কা দিয়ে মনোনয়ন পেয়েছি। এখন জয় নিয়ে আর কোনো টেনশন নেই। এখন আমি কে সেটার চেয়ে প্রশাসনসহ সবার কাছে নৌকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’বরগুনা সদরের ঢলুয়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন আজিজুল হক। তিনি বলেন, ‘এলাকায় খুব উন্নয়ন করেছি। জনগণের সঙ্গে আছি। নৌকা থেকে মনোনয়ন পাওয়ায় জয় অনেকটাই সুনিশ্চিত।’ ময়মনসিংহের ফুলপুরের এক প্রার্থী বলেন, ‘পৌরসভা নির্বাচনের মতোই ফল হবে ইউনিয়নে।’
বরিশালের গৌরনদীর মাহিলাড়া ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া সৈকত গুহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আগাম প্রচার শুরু করেছিলাম। সেই প্রচারণা এখনো চলছে। বিজয়ী না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরব না।’ দলীয় মনোনয়ন পাওয়াকে বিজয় মনে করছেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই।’
প্রথম পর্বের ইউপি নির্বাচনের চেয়ারম্যান পদের প্রার্থীদের দলীয় মনোনয়নপত্র বিতরণ শেষ করেছে আওয়ামী লীগ। আজ সোমবারের মধ্যে দ্বিতীয় ধাপের সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা পাঠাতে তৃণমূল বোর্ডকে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। প্রথম ধাপের ৭৩৯ ইউনিয়নে ভোট গ্রহণ আগামী ২২ মার্চ। আর ৩১ মার্চ ভোট হবে পরবর্তী ধাপের ৬৮৪টি ইউনিয়নে। এরই মধ্যে সম্ভাব্য প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়, স্থানীয় সাংসদ ও কেন্দ্রীয় নেতাদের বাসা-কার্যালয়ে দৌড়ঝাঁপ করছেন।
আওয়ামী লীগের দুজন দায়িত্বশীল নেতা বলেন, দল ক্ষমতায় বলে প্রশাসনও তৃণমূল নেতাদের সমঝে চলে। তাই দলীয় প্রধানের সই করা মনোনয়ন পাওয়া মানেই বিজয় ভাবছেন প্রার্থীরা। এ জন্য একেক ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী চার-পাঁচজন। আর বিএনপি অনেক স্থানে প্রার্থীই পাচ্ছে না।দীর্ঘদিন ধরেই বিএনপি বা অন্য দলের সমর্থন নিয়ে জয় পাওয়া কিছু কিছু ইউপি চেয়ারম্যান এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। এভাবে মনোনয়ন পাওয়া অনেক প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয়। কয়েকবার ইউপি চেয়ারম্যান হয়েছেন এমন প্রার্থীও আছেন। কিন্তু বিরোধী দলের প্রার্থী হয়ে প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে আগ্রহী নন।
মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানের কোলা ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সদস্য মীর লিয়াকত আলী ৮ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে মনোনয়ন পেয়ে গেছেন। গত বুধবার এর প্রতিবাদে স্থানীয় আওয়ামী লীগ সড়ক অবরোধ করে। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নুর ইসলাম বলেন, উপজেলা আওয়ামী লীগ জোর করে বিএনপির প্রার্থীর নাম কেন্দ্রে পাঠিয়েছে। তাঁরা এতে সই করেননি।
সাতক্ষীরার কালীগঞ্জের ধলবাড়িয়া ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান গাজী শওকত হোসেন বিএনপি ঘরানার লোক হিসেবে পরিচিত। গত বছর আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে দলের মনোনয়ন পেয়েছেন। এ বিষয়ে শওকত হোসেন বলেন, ‘অতীতে আমি কোনো দলের রাজনীতি করি নাই। চেয়ারম্যান-মেম্বারগিরিই মূল কাজ ছিল। ২০১১ সাল থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করছি।’সাতক্ষীরা সদরের ঝাউডাঙ্গায় জামায়াত পরিবারের সদস্য আজমল হোসেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। অবশ্য এ বিষয়ে কথা বলার চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। ওই ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম সদর উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তিনিও আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে নিজের ছবিসংবলিত ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে পোস্টারও ছাপিয়েছিলেন। পরে অবশ্য বিএনপিতে থেকে গেছেন এবং দলের মনোনয়ন পেয়েছেন। এ বিষয়ে রফিকুল ইসলাম বলেন, উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের স্বার্থে স্থানীয় সাংসদ মীর মোস্তাক আহমেদের সঙ্গে তাঁর ‘কাজের’ সম্পর্ক রয়েছে। এ জন্যই এমন প্রচার হতে পারে।
অন্য দল থেকে আসাদের মনোনয়নের বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, তৃণমূল থেকে পাঠানো তালিকা ও দলের নিজস্ব প্রক্রিয়ায় সংগৃহিত প্রতিবেদন অনুযায়ী মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এর পরেও কয়েকটি অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগগুলো পর্যালোচনা করা হয়েছে।
বরগুনা জেলার আমতলী উপজেলার আঠারগাছিয়ায় হারুন-অর-রশিদ ও আরপাঙগাশিয়ায় সুলতান আহম্মেদ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। তাঁদের দুজনের মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়ে বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির বলেন, তাঁরা আওয়ামী লীগের কোনো পদেই নেই। তাঁরা বিএনপির রাজনীতি করতেন। অবশ্য হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘আমি কোনো পদে নেই, এটা ঠিক নয়। উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য পদে আছি।’ নৌকা মার্কা পাওয়ার কারণে তিনি জয়ী হবেন বলে জানান।
মনোনয়ন নিয়ে জেলা-উপজেলায় গরমিল দেখা গেলেও কেন্দ্রীয় ভাবে তা যাচাই করা হচ্ছে। কিন্তু স্থানীয় লোকবলের দাপটে কোন কোন এলাকায় ভিন্ন দলের প্রার্থিরা তুমুল জনপ্রিয়। তাদের আওয়ামীলীগে যোগ দেওয়ার প্রচেষ্টা দলের জন্য খুব একটা আশাজনক বলে মনে করছেন না বিশ্লেষকরা।