ঘরের সামনের দিকটা অন্ধকার। যদিও একটা বাল্ব তেরছা ভঙ্গীতে ঝুলে আছে দরজার ঠিক ওপরে। হয়তো সেটা নষ্ট, কিংবা হতে পারে বিদ্যুৎ বিল বাঁচানোর জন্যে জ্বালানো হয় না, অথবা হতে পারে আঁধার চিরস্থায়ী নয় ভেবে জায়গাটা প্রতি রাতেই অন্ধকার হয়ে থাকে। আশে-পাশে আর কোথাও আলো নেই। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোও ম্লান হতে হতে একেবারে মিলিয়ে গেছে দরজার সামনের অন্ধকার জায়গাটুকুর কিছু আগে। যে কেউ অন্ধকারে একটু তীক্ষ চোখ বোলালেই দেখবে দরজাটা পুরোনো কাঠের, ঘুণে কাটা কুৎসিত সব ক্ষত গায়ে অনেককষ্টে দাঁড়িয়ে আছে যেন।
ঘরের ভেতর দুটো রুম, একটি বাথরুম কাম টয়লেট, পাশেই রান্নাঘর। রান্নাঘর আয়তনে তিন ফিট বাই তিন ফিট। রান্নাঘরের হাড়ি-পাতিলগুলিতে বহু দিনের ব্যবহারে কালচে বর্ণের রাজত্ব। গ্যাসের চুলোর চারপাশে আধইঞ্চি পুরু ময়লার আবরণ। দর্শনীয় কিছু থাকলে ওই আধইঞ্চি ময়লার আবরণই দেখার মত বস্তু। অবহেলা, অজ্ঞানতা কিংবা জেনে শুনে নিরাসক্ততাকে মেনে নেয়ার মতন করে হয়তো ঘরের বাসিন্দারা ওই ময়লাটুকুকেও মেনে নিয়েছে; পরিষ্কার করার চেষ্টার বদলে বরং ওগুলোর জমে যাওয়া অলিখিত নিয়ম পেয়ে গেছে। মাঝখানের ঘরের সিংহভাগ দখল করে রেখেছে একটি সস্তা খাট। খাটের পায়ার কাছে একটি আলনা, মেয়েলি কাপড়ে ঠাসা। ভেঙেচুড়ে পড়ে যাবে এমন অবস্থা। পাশেই ছোট্ট একটি টেবিল। ওটাতে স্তুপ হয়ে আছে ছোট বড় নানা আকারের ফিজিক্স-ক্যামিস্ট্রি-বায়োলজির বই।
বইগুলোর সামনে টেবিলে একটি প্র্যাকটিক্যাল খাতা মেলে মনোযোগ দিয়ে লিখছে মুন। চেয়ারে সে বসে আছে ডান হাঁটু মুড়ে, হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে। সুতির রঙচঙে সালোয়ার কামিজ পরনে। ওড়নার অর্ধেকটা খাটের ওপর স্তুপ হয়ে আছে বাকি অংশ ঝুলছে খাটের বাইরে। আজ চুলে দুটো বেণী করেছে মুন। বেণী দুটো পিঠের ওপর পড়ে আছে নির্জীব সাপের মতন এঁকেবেঁকে। মুনকে খুব রূপসী বলা যাবে না। ছিপছিপে শরীর, শ্যামলা গায়ের রঙ। শ্যামলা হলেও মুখখানায় একটা মিষ্টিভাব আছে। রাস্তায় বেরুলে সবাই হয়তো খাইখাই দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে না, তবে দু-একজন আড়চোখে নিশ্চয় তাকায়।
সামনের ঘর ব্যবহার হয় বৈঠকখানা হিসেবে। একটি ওয়ারড্রব আছে ডানপাশে, ঘরের কোণায়। নতুন-পুরোনো অনেকগুলো ধুলোজমা পত্রিকা এলোমেলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ওয়ারড্রবের উপর। আর আছে একটি ডাবল, দুটো সিঙ্গেল সোফা। রঙ চটে যাওয়া সোফাগুলো দেখেই বোঝা যায়- সেকেন্ড হ্যান্ড। দুপাশে সোফার মাঝখানে ছোট টি-টেবিল। ওটার উপর খোলা একটি বিনোদন ম্যাগাজিন।
সিঙ্গেল সোফায় বসে আছেন শর্মিলা। চোখ ম্যাগাজিনে, কিন্তু ম্যাগাজিন পড়ছেন না তিনি। তাঁর ভঙ্গীটা এমন, যেন কারো আসার অপেক্ষা করছেন। শীতের সন্ধ্যার নিরানন্দ অপেক্ষা। অবশেষে একসময় হয়তো তাঁর অপেক্ষারই অবসান ঘটিয়ে দরজার গোড়ায় শোনা গেল কাশির শব্দ সমেত বাড়িওয়ালার মোটা কণ্ঠস্বর- ‘মুনের মা বাসায় আছো নাকি?’
সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল শর্মিলার। ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘আছি। আসুন।’
মধ্যবয়স্ক বাড়িওয়ালা ঢুকলেন ভেতরে। কড়া ইস্ত্রি দেয়া সাদা পাঞ্জাবী আর বনেদী লুঙ্গি পরনে। কাঁচা-পাকা অবশিষ্ট চুল দিয়ে বেশ কৌশলে ঢেকেছেন চকচকে টাক। গায়ে জড়িয়েছেন কাশ্মিরি শাল। ঘরে ঢোকা মাত্র দামী পারফিউমের ঘ্রাণে ভরে উঠল ছোট্ট ঘরটা। এই পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে এসেও তিনি বেশ সৌখিন। টাকার অভাব নেই। আশে-পাশের তিনটে বাড়ির মালিক। একটি বাড়ির এক অংশে এই সেমিপাকা ঘরও পড়েছে। ভদ্রলোক বিপত্নীক। দুই মেয়ে। বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছোটটা মুনের চেয়ে বছরখানেকের বড় হবে, ভার্সিটিতে পড়ে। ইদানিং শোনা যাচ্ছে তিনি হজ্জ করতে যাবেন।
বাড়িওয়ালা সুপরিপুষ্ট উদর নিয়ে সোফায় বসতেই মৃদু ক্যাঁচকোঁচ করে প্রতিবাদ জানাল সেটা। বসেছেন শর্মিলার মুখোমুখি।
হাসিমুখে বললেন, ‘ভাড়া নিতে এলাম, মুনের মা।’
কুঁকড়ে গেলেন শর্মিলা। চারমাসের ভাড়া বাকি। এই মূহুর্তে ভাড়া দেয়ার সামর্থ্য নেই তাঁর। এই ভাঙাচোরা দেড়খানা রুমের ভাড়া পাঁচ হাজার হাজার টাকা। এই টাকাটাও যোগাড় করা রীতিমত দুঃসাধ্য তাঁর জন্যে। একটা এন.জি.ও-র মাঠকর্মী তিনি। তাঁর কাজ, পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে অশিক্ষিত মহিলাদের ফ্যামিলি প্ল্যানিং বোঝানো। যা বেতন পান, তাতে কোনরকমে খাওয়া খরচ আর মুনের পড়াশুনার খরচ হয়তো চালানো যায়, কিন্তু ঘরভাড়া নিয়মিত দেয়া সম্ভব হয়না। সর্বোচ্চ কৃচ্ছতা অবলম্বন করে অল্প অল্প জমিয়ে দু-একমাসের ভাড়া পরিশোধ করেন মাঝে মাঝে।
শর্মিলা ম্যাগাজিন বন্ধ করে বললেন, ‘এখনো যোগাড় করতে পারিনি ভাইসাহেব। যোগাড় হলে আমি নিজেই গিয়ে দিয়ে আসতাম। আপনাকে কষ্ট করে আসতে হত না।’
‘সে-কী আর আমি জানিনা। তারপরও এলাম একবার। যা হোক, মুনের বাবার কোন খোঁজ পেলে?’
এই প্রসঙ্গ শর্মিলার জন্যে চিরকালই অস্বস্তিকর। এ প্রসঙ্গ না উঠলেই বাঁচেন। অথচ পরিচিত লোকজন দেখা হলেই প্রথমে এই প্রসঙ্গ তুলবে। যেন পৃথিবীতে কথা বলার আর কোন বিষয় নেই। তাঁকে ঘুরে ফিরে ওই একই প্রশ্ন প্রতিদিন কম করে হলেও তিনবার শুনতে হয়। মাঝে মাঝে চিন্তা করেন অন্য কোথাও গিয়ে থাকার, যেখানে চেনা কেউ থাকবে না। কিন্তু সে চিন্তা তাঁর জন্যে স্রেফ চিন্তাই। সে চিন্তা বাস্তবে রুপান্তর করার মত মানসিক শক্তি তাঁর নেই। ভাবেন- জীবন আর কতটুকুই বা! বাকি দিনগুলি ঠিক কেটে যাবে রয়ে সয়ে। কি দরকার শুধুশুধু অচেনা জায়গায় গিয়ে বিপদে পড়ার? এখানে আর কিছু না হোক খেয়ে পরে তো বাঁচা যাচ্ছে। জীবনে বেঁচে থাকাটাই মূখ্য আর অন্য সব- মান, অপমান, লজ্জা, নীতি, যুক্তি, সম্মান গৌণ।
তিনি ছোট্ট করে জবাব দিলেন, ‘না।’
‘আমি বুঝি তোমার সংসার চালাতে কত কষ্ট হয়। স্বামী বিদেশে গিয়ে লাপাত্তা। তুমি একা মেয়েমানুষ খেটে মরছ। সব দায়িত্ব তোমার কাঁধে। কিন্তু কি করব বলো? আমারও টাকা দরকার হয়। এদিকে সামনে হজ্জে যাচ্ছি, অনেক টাকা….’ কথা অসমাপ্ত রেখে বাড়িওয়ালা লালচে চোখে তাকালেন। চোখে কোন ভাব নেই। কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। শর্মিলা উঠে দাঁড়িয়ে অফিসের ব্যাগ হাতে নিয়ে বিকৃত স্বরে ডাকলেন, ‘মুন!’
মুন সামনের ঘরে এলো। শান্ত চোখে জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু বলবে মা?’
‘আঙ্কেলকে চা দাও, আমি একটু বেরুচ্ছি। ভাইসাহেব আপনি বসুন, চা খান। তালপাড়ায় আমার একটা মিটিং আছে। এন.জি.ও-র কাজ বোঝেনইতো, রাত-দিন নেই।’
ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার সময় পেছনে না তাকিয়ে খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন, ‘মুন দরজা আঁটকে দাও, ঠান্ডা ঢুকছে!’
দরজা আঁটকানোর শব্দ পেতেই ব্যস্ত ভঙ্গীতে হাঁটতে শুরু করলেন শর্মিলা। যেন সত্যিই তাঁর কোন কাজ আছে।