১১ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

অপরিকল্পিত উন্নয়নে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম

অপরিকল্পিতভাবে নেওয়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে ক্রমশ বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম। অপরিকল্পিত উন্নয়ন এখন চট্টগ্রামবাসীর ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, নগরবাসীর সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনায় না নিয়ে এবং সঠিকভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই ওপর থেকে প্রকল্প চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মানুষের স্বাচ্ছন্দ্যের পরিবর্তে এসব প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যই ছিল দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে পকেট ভর্তি করা। তাছাড়া, যেসব সুযোগ-সুবিধার আশ্বাস দিয়ে প্রকল্প শুরু করা হয়েছিল, এখন তার সঙ্গে বাস্তবতার সামান্যই মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি ঋণের টাকায় তৈরি করা প্রকল্পগুলো এখন নগরবাসীর গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে।

নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে গত ৭ বছর ধরে চলমান রয়েছে চারটি ভিন্ন প্রকল্প। সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকার এসব মেগা প্রকল্পের সুফল এখনো দৃশ্যমান নয়। বছরের যে কোনো সময় সামান্য বৃষ্টিতেই নগরীর অধিকাংশ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে গিয়ে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। গত তিন বছরে জলাবদ্ধতার সময় খাল ও অরক্ষিত নালায় পড়ে ১০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছে। ৩০ বছর আগেও এই নগরীতে ৭০টি খাল ছিল, যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক খালই অপরিকল্পিতভাবে রাস্তাঘাট ও আবাসিক এলাকা নির্মাণের কারণে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এ কারণে জলাবদ্ধতা প্রকল্পের টাকা জলেই গেছে বলে মনে করেন নগরবাসী।

১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত দেশের প্রথম টানেলটি কোনো কাজে আসছে না নগরবাসীর। মূল নগরী থেকে অনেক দূরে হওয়ায় টানেল দিয়ে তেমন একটা যানবাহন চলে না।

জানা গেছে, টানেল থেকে প্রতিদিন টোল বাবদ আয় হয় গড়ে ১১ থেকে ১২ লাখ টাকা। কিন্তু ব্যয় হয় ৩৭ লাখ টাকা। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় টানেলটি এখন শ্বেতহস্তীতে পরিণত হয়েছে। এ বছর থেকে টানেলের জন্য নেওয়া চীনা ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু করতে হবে। আয় কম হওয়ায় রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় অন্যান্য সেতুর আয় থেকে মেটাতে হবে। ফলে ঋণ পরিশোধে সরকারকে রাজস্ব খাত থেকে ভর্তুকি দিতে হবে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ২০১৫ সালের নভেম্বরে ‘কনস্ট্রাকশন অব মাল্টি লেন রোড টানেল আন্ডার দ্য রিভার কর্ণফুলী’ শীর্ষক টানেল প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের জুনে। তবে নির্মাণকাজ উদ্বোধন করা হয় ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় প্রায় ৮ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। পরে ব্যয় বেড়ে হয় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে নেওয়া হয়েছে চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে।

গত বুধবার নগরীর সার্কিট হাউজে সম্মিলিত নাগরিক ফোরাম চট্টগ্রাম আয়োজিত নাগরিক সংলাপে বক্তারা বিভিন্ন অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে নানা অভিযোগ করেন। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দর খানের সভাপতিত্বে ‘নতুন স্বপ্ন ও নতুন বাস্তবতায় চট্টগ্রাম ভাবনা’ শীর্ষক সংলাপের মূল আলোচক প্রকৌশলী সুভাষ চন্দ্র বড়ুয়া বলেন, অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে চট্টগ্রাম নগরী বাসযোগ্যতা হারানোর দ্বারপ্রান্তে। যানজট, জলজট নগরবাসীর নিত্যসঙ্গী। দূষিত হচ্ছে বায়ু, পানি, শব্দ, নদী ও খাল। হারিয়ে যাচ্ছে জলাশয়, পাহাড়, নদী ও বন। যেসব উন্নয়ন হয়েছে তা অজ্ঞতা, অক্ষমতা ও জবাবদিহিহীন কর্তৃত্ববাদের যোগফল। তথাকথিত উন্নয়ন বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণে আসবে না। জনগণের ঘাড়ে চেপে বসেছে ঋণের বোঝা যা হাজার বছর ধরে বহন করতে হবে।

অনুষ্ঠানে বৈষম্য-বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা বলেন, চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প নগরবাসীর কোনো কাজেই আসেনি। সামান্য বৃষ্টিতেই নগরীর বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে যাচ্ছে পানির নিচে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম নগরীতে খালের সংখ্যা ছিল ৭০টি। অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে এখন তা ৩৬টিতে নেমে এসেছে। তিনি রেকর্ড অনুযায়ী বাকি ৩৪টি খাল উদ্ধারের পাশাপাশি নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের প্রকৃত ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের ব্যয় প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আমীর উদ্দিন বলেন, আমাদের মাতৃভূমি হীরক রাজার দেশে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পে ২ হাজার কোটি খরচ হয়েছে। বাকি টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা করে লোপাট হয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, চট্টগ্রামে ওয়াসা, সিডিএ, সিটি কর্পোরেশন, বন্দরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব নিয়ম অনুযায়ী কাজ করে। পরিকল্পিত শহর গড়তে হলে এদের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে।

Share on facebook
Share on twitter
Share on whatsapp
Share on print

মন্তব্য করুন

সর্বশেষ সংবাদ