আকাশ ইকবাল:
আমার বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল আমি সেনাবাহিনীতে ক্যারিয়ার গড়ে তুলি। কিন্তু আমার স্বপ্ন ছিল আমি সাংবাদিক হবো। এই নিয়ে বাবা-মায়ের সাথে অনেক ঝগড়াও হয়েছে। এক সময় বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে কলেজে পড়াকালীন বিএনসিসি’তে যোগ দিয়েছিলাম। বিএনসিসি’র ক্রেডেট হয়ে সেনাবাহিনীতে কয়েকটা প্রশিক্ষণেও অংশ গ্রহণ করেছিলাম। এক সময় চাকরিটাও নিশ্চিত হয়েছিল। কিন্তু নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হওয়ায় অনেক চিন্তা ভাবনা করে আর যোগ দেওয়া হয়নি। বাবা-মা আমাকে বুঝাতে চেয়েছিলেন, সরকারি চাকরি স্থায়ী। বেতন ভালো, ফেনশন ছাড়াও আরো অনেক সুযোগ সুবিধা। অন্যদিকে সাংবাদিকতায় তেমন টাকা নেই। মায়ের অমুক পরিচিত সাংবাদিক আছে। তাঁর কষ্টের উদাহারণ আমাকে শোনালো। আমি সেদিন বাবা-মাকেও কিছু বুঝাতে চেয়েছিলাম। যদিও তারা বুঝেনি। উল্টা আমাকেই বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলল।
আমাদের বর্তমান সমাজের চারদিকে অন্যায় আর অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জর্জরিত। অনেক সাংবাদিকরাও অন্যায় অপরাধমূলক কার্মকান্ডে জড়িত থাকার খবর প্রায়ই পাওয়া যায়। আমি প্রথম যে দিন সাংবাদিকদের মূল কাজ সম্পর্কে জানতে পেরেছিলাম সেদিনই ঠিক করে নিয়েছিলাম আমার পেশা কি হবে। ভবিষ্যতে কি পেশা আমি বেছে নেবো? আজ ওই পেশাই আমি গ্রহণ করে নিয়েছি। জানিনা এখনও সাংবাদিক হতে পেরেছি কিনা। কিন্তু হওয়ার জন্য মন থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছি।
সাংবাদিকতা একটা মহান পেশা। সাংবাদিকদের জাতির বিবেক বলা হয়। সাংবাদিকতা রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। গণতন্ত্রের স্বার্থকতার জন্য সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দুস্থ মানবতার পাশে দাঁড়ানো এবং সমাজের অন্ধকার দিকটা জনসম্মুখে উম্মোচন করার ক্ষেত্রে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের ভূমিকা অদ্বিতীয়। শুধু তাই নয়. রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভ নির্বাহী, বিচার ও আইন বিভাগ যে দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পাদন করে তা জনসম্মুখে তুলে ধরার ক্ষেত্রেও সাংবাদিকদের গুরুত্ব অনেক। প্রজাতন্ত্রের কর্মীদের সরকারি দায়িত্ব পালনে ভুলত্রুটি, অবহেলা এবং তাতে যে ভোগান্তী সৃষ্টি হয় তা তুলে ধরেন সাংবাদিকরা। মূলত এই চিন্তা থেকেই আমার সাংবাদিকতা পেশায় আশা। এই লক্ষে স্কুলে পড়ার সময় থেকে স্থানীয় পত্রিকার সাথে যুক্ত হওয়া। বর্তমানে কাজ করছি একটা জাতীয় দৈনিকে। আর সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা প্রায় পাঁচ বছর। এই পাঁচ বছর খুব সহজে পার হয়নি। এর মধ্যে রয়েছে দুঃখ-কষ্ট, সুখ-আনন্দ। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। রয়েছে অনেক ঘটনা।
৫৭ ধারা নামের একটা আইন যেমন সাংবাদিকদের হাত ও মুখ বেধে রেখেছিলো ঠিক তেমনি সমাজের কিছু মানুষের কাছেও অনেক সাংবাদিক বন্ধী। এখন আবার ৫৭ ধারাকে ৩২ এ আনা হচ্ছে। এখন তো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ও মফস্বল সাংবাদিকতায় আরো হুমকির মুখে পড়বে।
আজকাল সাধারণ মানুষ সাংবাদিকদের তাদের বন্ধু না ভেবে শত্রু মনে করেন। আবার কারও কারও মুখে শোনা যায় সাংবাদিকরা দালাল, কেনা গোলাম। খুব সাম্প্রতিক সময়ের একটা ঘটনা বলি। ২৯ জানুয়ারি ২০১৮ দৈনিক কালের কন্ঠের অনলাইন ভার্সনে একটা সংবাদ প্রকাশিত হয়, ‘পুলিশ-সাংবাদিক সব আমাদের কেনা’ শিরোনামে। এই শিরোনাম দেখে সাথে সাথে লিঙ্কে ক্লিক করে দেখলাম, বাংলাদেশ জনস্বাস্থ্য কেন্দ্র নামের এক পতিষ্ঠান গত ১২/০৯/২০১৭ তারিখে বিজ্ঞাপন দেয়। গত ২৯/০১/২০১৮ সোমবার ওই প্রতিষ্ঠানের একটি নাম্বার থেকে এক আবেদনকারীর ফোনে কল আসে টাকা পাঠানোর জন্য। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে তদন্ত করলে উক্ত প্রতিষ্ঠানের এক নারী কর্মী তদন্তকারী সাংবাদিককে হুমকি দিয়ে বলেন, ‘পুলিশ-সাংবাদিক সব আমাদের কেনা’, ‘বেশি বাড়াবাড়ি করলে সমস্যা হবে’। এটা শুধু প্রাতিষ্ঠানিক চিত্র নয়। আমাদের দেশের ভোটের রাজনৈতিক নেতারাও সাংবাদিকদের অর্থের বিনিময়ে কিনে নেয়। গত পৌর মেয়র নির্বাচনে আমার পরিচিত এক সাংবাদিক সহকর্মীকে ডেকে এক মেয়র প্রার্থী কেনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এই প্রস্তাব পাওয়ার পর ওই সহকর্মী খুব ভেঙে পড়েন। কারণ, কি সাহস হয়েছে, কিভাবে একজন মেয়র প্রার্থী একজন সাংবাদিক কেনার প্রস্তাব দেয়? এই সাহস কোথায় পায়? নিশ্চই এই সাহস নেতাদের কাছে বিক্রয় হওয়া সাংবাদিকদের দেখে হয়।
বর্তমানে সাংবাদিকরা বিক্রয় হয়। মোটা অংকের টাকার কাছে। আমি মফস্বল থেকেই উঠে এসেছি। সব সময় চেষ্টা করেছি সৎ থেকে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ তুলে ধরার। এই বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করতে গিয়ে ক্ষমতাধর রাজনৈতিক নেতাদের অনেক হুমকি ধামকি পেয়েছি। কয়েকবার মারও খেয়েছিলাম। কিন্তু এরপরও আমার আদর্শর জায়গা থেকে আমি এক পাও নড়িনি। এক সময় খুব আলোচিতও হয়ে উঠি। এই সময় একটা প্রতিষ্ঠান থেকে আমাকে প্রস্তাব পাঠানো হয় মফস্বলে তাদের প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করতে। বলা হয় মিডিয়া পার্টনার। এই বিষয়ে আমার আগ্রহ না থাকার পরও আমার সাংবাদিক নেতার কাছ থেকে কাজ সম্পর্কে জেনে নিলাম। আমি সেই প্রস্তাবে রাজি হইনি। এরপরে ওই প্রস্তাবে আমার এক সহকর্মী তাদের প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করছিল। একদিন আমার সহকর্মী আমাকে বলল, ‘বন্ধু আমি তো কেনা গোলাম হয়ে গেলাম’। আমি বাকি আর বললাম না বিস্তারিত। আমার প্রায় অনেক পরিচিত উকিল আছেন যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করছেন। তাদের কাজ হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের সকল সমস্যা, যেমন প্রতিষ্ঠানের অপরাধ মূলক সমস্যাগুলোও সামাল দেওয়া। এর বিনিময়ে মোটা অংকের টাকা পায়। আমাদের দেশের সামনের সারির সংবাদ মাধ্যমগুলোও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের। নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থেই এই সংবাদ মাধ্যম করা। মাঠে কাজ করা যে সব সংবাদ কর্মী আছে তারা অনেকেই বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ তুলে ধরে। অনেক সময় দেখা যায়, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ সংগ্রহ করার পরও পত্রিকার প্রকাশক সম্পাদকরা ওই সংবাদ ছাপায় না। কারণ তারাও অন্য প্রতিষ্ঠানের সাথে কোন না কোন ভাবে চুক্তিবদ্ধ মানে বিক্রয় হয়ে যাওয়া।
সাংবাদিকতা পেশায় যারা আসে তারা সব সময়ই খুব সাধারণ হয়। সৎ ও আদর্শবান সাংবাদিকদের জীবনে খুব বেশি টাকার প্রয়োজনও পড়ে না। এই যেমন আমার কথা বলি, একটা জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় কাজ করে কতটাকা বেতন পাই? কোন কর্পোরেট চাকরিজীবীর বেতনের তুলনায় খুবই নগণ্য। তারপরও আমার জীবন চলে যাচ্ছে। এতেই আমি খুশি। আমার সাংবাদিক ভাইদের উদ্দেশ্যে বলছি, সাংবাদিকতা পেশাটা খু¦বই সম্মানীয়। আমি উপরেও বলেছি সাংবাদিকরা জাতীর বিবেক। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। রাষ্ট্রে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া ভালো-খারাপ যে কোন ঘটনা সাংবাদিকদের মাধ্যমেই জাতির সামনে উঠে আসে। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন এই দেশটাকে সোনার বাংলায় পরিণত করতে। কিন্তু তার আগেই ওনাকে রাজাকার দোষররা স্বপরিবারে হত্যা করে। আমি মনে করি, আমরা যদি বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করার মাধ্যমে এগিয়ে যাই তাহলে খুব সজহে সোনার বাংলা রূপান্তর করতে পারবো। এই পেশাটাকে সম্মান করতে শিখুন। এই পেশাকে অসম্মান করবেন না। আর শপৎ নিন, আমি এক মহুর্তের জন্যও অসৎ হতে চাই না। আমি কারও কেনা সাংবাদিক হতে চাই না।
লেখক: সংবাদকর্মী।